মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশে দেশে বাংলা ভাষা

বিশেষ প্রতিনিধি

রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়ে ‘বাংলা’ আজ বিশ্বের চতুর্থ বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে সাইনবোর্ড, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রেলস্টেশন, মেট্রো স্টেশন এবং বহু সড়কের নামফলকে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক বিদেশি তাদের নিজ দেশে বাংলা ভাষায় গবেষণা করছেন, কথা বলছেন। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এর মধ্যে ২৬ কোটিরও বেশি বাংলা ভাষাভাষীর বসবাস বাংলাদেশ ও ভারতে। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাকি ৪ কোটিরও বেশি মানুষ ছড়িয়ে আছেন বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় সোয়া কোটি বাঙালি বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। কোনো কোনো দেশে মূল জনগোষ্ঠীর চেয়েও বাঙালি অভিবাসীর সংখ্যা বেশি। তারা সেখানে নিজেদের মধ্যে বাংলাচর্চার পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশে বিস্তৃত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে, বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে কাজ করছেন কয়েক লাখ বিদেশি। চীন, জাপান, রাশিয়া, কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে কাজ করছেন। তারা প্রতিদিনের কাজ উপলক্ষে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। অনেকে নিজেদের দেশে প্রতিষ্ঠিত বাংলা শেখার প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা শিখে এ দেশে আসেন। বাংলা এখন শুধু বাংলাদেশেরই দাফতরিক ভাষা নয়, ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এবং সিয়েরা লিওনের দাফতরিক ভাষা বাংলা। বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যে ত্যাগ ও সৌহার্দ্যরে স্বাক্ষর রেখেছেন তারই নিদর্শন হিসেবে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলা ভাষা শিখছেন, চর্চা করছেন। দেশে দেশে যেখানেই বাংলা কমিউনিটি রয়েছে সেখানেই বাংলা ভাষার প্রচলন বাড়ছে। এদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) গতকাল বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সহজ করতে ইউএন বাংলা ফন্ট ইউনিকোড সংস্করণ চালু করেছে।

জানা গেছে, পাকিস্তানের করাচিতে প্রায় ২১ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। করাচি সিটি করপোরেশনের অন্যতম অফিশিয়াল ভাষাও বাংলা। ইংল্যান্ডে স্বীকৃত পঞ্চম অভিবাসী ভাষা বাংলা। সেখানে প্রায় ৮ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও আছেন প্রচুর বাঙালি অভিবাসী। এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা- যেখানে বাঙালি সেখানেই বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়, মার্কেটে, মেট্রো স্টেশনে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাংলায় সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়।

৪টি মহাদেশের ৩০টি দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। গবেষকেরা মনে করছেন, ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পর বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বে আগ্রহ বাড়ছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ৩০টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা হয়। এসব গবেষণায় বিদেশি গবেষক ছাড়াও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গবেষকেরাও যুক্ত আছেন। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে উনিশ শতক থেকেই প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগের অধীনে বাংলা নিয়ে গবেষণাকাজ চলছে। যুক্তরাজ্যে বাংলা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করছেন অনেক বিদেশি। যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইসকনসিন ও হার্ভার্ড উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় অনেক বিদেশির বইও প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা ভাষা শেখানোর বাইরেও গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও লালন সাঁইকে নিয়ে। ক্লিনটন বি সিলি, র‌্যালফ নিকোলাস, ক্যারল সলোমন, ক্যারোলিন রাইট, হেনরি গ্লাসি প্রমুখ বিদেশি বাংলা গবেষকের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাচর্চার প্রসার ঘটেছে। কানাডার জোসেফ ও’কনেল এবং ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসনসহ বেশ কয়েকজন বাংলায় অধ্যাপনা ও গবেষণা করেন।

জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক জার্মান নাগরিক বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও গবেষণা করেছেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের হান্স হারডার গবেষণা করেছেন চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার নিয়ে। তিনি প্রাচীনতম বাংলা কবিতা চর্যাপদ নিয়েও গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এলভিয়েতা ওয়াল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ রচনাবলি অনুবাদ করেছেন। বেলজিয়ামের নাগরিক ফাদার দ্যতিয়েন গবেষণা করেছেন বাংলা ভাষার পুরনো বই ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে। ডেনমার্কের আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এশিয়ায় বিশেষভাবে বাংলার চর্চা হয় জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। তবে জাপান ও চীন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুও আজুমা রবীন্দ্র-অনুরাগ থেকে বাংলা ভাষাচর্চা শুরু করেছিলেন। জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জাপানি গবেষক সেখানে বাংলা নিয়ে কাজ করছেন। কয়েক বছর আগে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষা শেখানো। জাপানি শিক্ষার্থীরা সেখানে বাংলা ভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশে যেসব জাপানি কর্মী নানা প্রকল্পে কাজ করতে আসেন তাদের অনেকে টোকিও ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টাডিজ থেকে বাংলা শিখে আসেন। ইতোমধ্যে চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে নিয়মিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাস চালু হয়েছে বলে জানা গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের এই সময়ে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন ধরনের চর্চা শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খোলা হচ্ছে, একাডেমিক কোর্স চালু হচ্ছে, অনেকেই বাংলা নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষকদের মতে, ইংরেজি ও চীনা ভাষার পরই বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর এই আগ্রহ আরও বেড়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহের কারণে বিশ্বের অন্তত ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষায় আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ছয়টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে।

জাতিসংঘে বাংলা ফন্ট এখন ইউনিকোডে : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সহজ করতে ইউএন বাংলা ফন্টের সাতটি ভিন্ন প্রতিলিপিসহ ইউনিকোড সংস্করণ চালু করেছে। ইউএন বাংলা ফন্টটি ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অফলাইনে ব্যবহারের জন্য একক সংস্করণসহ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার এবং গুডউইল অ্যাম্বাসাডর জয়া আহসান গতকাল ঢাকায় সংস্থার কার্যালয়ে ইউনিকোড সংস্করণটি চালু করেন।

ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান বলেন, বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০২০ সালে আমরা প্রথম ফন্টটি চালু করি। যেহেতু ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে, তাই আমরা সবার জন্য ইউনিকোড সংস্করণ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, এই ইউনিকোড সংস্করণটি বাংলা লেখার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করতে সহায়তা করবে। তিনি আরও বলেন, এখন যারা তাদের সেলফোন এবং কম্পিউটারে লেখেন তারা আরও বৈচিত্র্য পাবেন।

ইউএনডিপির শুভেচ্ছাদূত জয়া আহসান বলেন, আমরা যারা বাংলায় লিখি তাদের জন্য এটি একটি দুর্দান্ত উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ইউএনডিপির এই উদ্যোগের অংশ হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। ইউএনডিপির যোগাযোগ প্রধান মো. আবদুল কাইয়ুম বলেন, আমরা শিগগিরই এই ফন্ট ব্যবহার করে আমাদের ইউএনডিপি বাংলাদেশের ওয়েবসাইটের বাংলা সংস্করণ চালু করব। আমাদের অন্যান্য প্রকাশনাও এই ফন্ট ব্যবহার করবে। ফন্টটির ডিজাইনার মহিবুবুর রহমান রাজন বলেন, বাংলা লিপিতে অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। এর ধ্বনিতত্ত্ব, লিগ্যাচার ইত্যাদির বৈচিত্র্যের কারণে এ ফন্ট নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। ডিজাইনের ক্ষেত্রে অফারে এত বৈচিত্র্য আছে এমন খুব বেশি বাংলা ফন্ট নেই।

আজ অমর একুশে

ভাষার চাইতে অধিকতর জনগ্রাহ্য আর কী-ই বা হতে পারে

উচ্চ আদালতে এক ক্লিকেই ইংরেজি রায়-আদেশ বাংলায়

কুমিল্লার ৭০০ বিদেশি শিক্ষার্থীর মুখে বাংলা ভাষা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর