অরক্ষিত সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়াচ্ছে বেপরোয়া যানবাহন। সড়ক পরিবহন আইনের শিথিল প্রয়োগ এবং কার্যকর তদারকির অভাবে সড়কে ঠেকানো যাচ্ছে না মর্মান্তিক মৃত্যু। ফিটনেসবিহীন ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; মহাসড়কে মিশ্রগতির যানবাহন চলাচল; বেপরোয়া মোটরসাইকেল; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতার ঘাটতির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও নৈরাজ্য রোধ করা যাচ্ছে না। এ নৈরাজ্যের চক্রে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর সর্বাধিক ৭ হাজার ৭১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন ১২ হাজার ৬১৫ জন। বিশ্লেষকরা বলছেন, রবিবার মাদারীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু সড়ক নৈরাজ্যেরই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
এক দশকে দেশে ব্যাপকহারে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সেই মহাসড়কে চলাচল উপযোগী যানবাহন ও দক্ষ চালক তৈরি হয়নি। সড়কে বিপুলসংখ্যক ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করলেও ফিটনেস পরীক্ষার সক্ষমতাই নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর। ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কেও চালকরা অতিরিক্ত গতি, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক নিরাপদ ও দুর্ঘটনার প্রতিকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও সমন্বয়ের অভাবে কোনো উদ্যোগই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। উল্টো দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলেছে বছর বছর। দূরপাল্লার সড়কে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো মহাসড়কেই চালকদের জন্য বিশ্রামাগার তৈরি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে চালকরা অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ঘুম ও ক্লান্তি নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটান।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সড়কের অবকাঠামো পরিসর বাড়লেও ফেরেনি শৃঙ্খলা। সড়কে গতি বাড়াতে কর্তৃপক্ষ যতটা মনোযোগী, ঝুঁকি কমাতে সেরকম কোনো উদ্যোগ নেই। এক্সপ্রেসওয়েতে চলার জন্য মানসম্পন্ন পরিবহন, দক্ষ চালকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এসব তদারকিতে কারও নজর নেই। তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে চলে বেপরোয়া ফিটনেসবিহীন যানবাহন। লক্কড়-ঝক্কড় বাসের ধাক্কায় দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে পথচারীবান্ধব ফুটপাত গড়ে ওঠেনি। ফুটপাত চলে গেছে হকারদের দখলে। পথচারী চলাচলের জন্য রাস্তায় নেমে এলে ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। প্রয়োজন নেই এমন জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে ফুটওভার ব্রিজ। তাই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য সূত্রে জানা যায়, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৮২৯টি। এসব দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৬১৫ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১৯ জন নিহত, ৭৩ জন আহত এবং ৯২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ৩৫৪টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩২৬ জন নিহত এবং ১১৩ জন আহত হয়েছেন। এসব তথ্য জানিয়েছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। সংস্থাটি ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৩ হাজার ৯১ জন, বাস যাত্রী ৪২৭ জন, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি আরোহী ৪৫৩ জন, প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ যাত্রী ২৬৮ জন, থ্রি-হুইলার যাত্রী ১ হাজার ২৪৮ জন, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-চান্দের গাড়ি-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ৩৯৩ জন এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান আরোহী ২০৬ জন নিহত হয়েছেন।
শুধু মহাসড়ক নয়, রাজধানীতেও ফিটনেসবিহীন বেপরোয়া গাড়ির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। রাজধানীতে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই। বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চলাচল, পাল্লাপাল্লির কারণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। যত্রতত্র থামা, ওঠানামা করানো, ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন, বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহনের সাধারণ চিত্র। এদের কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। ঢাকায় বাস কোম্পানি আছে ২৪৬টি। আর বাস চলে প্রায় ১০ হাজার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপের তথ্য বলছে, সারা দেশের শহরগুলোতে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানী ঢাকায়। অধিকাংশ দুর্ঘটনা বাসের কারণেই হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এআরআইর গবেষণা তথ্য বলছে, বাসচালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই ঢাকায় বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকায় সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর সবকটিতেই বাসের বেপরোয়া চালানোকে দায়ী করেছে এআরআই।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের পরিবহন খাতকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন দক্ষ চালক। কিন্তু চালক তৈরিতে শুরু থেকেই গলদ চলছে। বর্তমানে যারা গাড়ি চালাচ্ছেন তারা শিখেছেন তাদের ওস্তাদের দেখে। ফলে সড়ক আইন, নীতিমালা, বাঁক, গতি সম্পর্কে তাদের জানাশোনায় ঘাটতি রয়েছে। সড়কে গতি বেড়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও চালকদের জ্ঞানের অভাবে ঘটছে দুর্ঘটনা। কিন্তু এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণক সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তদারিকর অভাব রয়েছে। এ কাজে তাদের গাফিলতিও স্পষ্ট। এভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। আমাদের মাদারীপুর প্রতিনিধি বেলাল রিজভী জানান, ঢাকার যাত্রাযাড়ী থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত চলে গেছে হাইওয়ে এক্সপ্রেস। এ মহাসড়কে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত রবিবার দ্রুতগতির একটি যাত্রীবাহী বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিহত হন ১৯ জন। গত জানুয়ারি পদ্মা সেতু টোল প্লাজার কাছে একটি অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় নিহত হন ছয়জন। শিবচরের চরবাঁচামারা এলাকায় দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনজন। ফেব্রুয়ারি মাসেও এক দুর্ঘটনায় চীনা নাগরিকসহ দুজন নিহত হয়েছেন। এক বছরে এরকম ৪০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, চালকরা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর ফলে অনেক সময় গাড়ি চালানো অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েন। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। এ মহাসড়কে অতিরিক্ত গতিতেও গাড়ি চলে। তাই প্রশাসনের উচিত সড়ক পরিবহন আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। মাদারীপুর পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, দ্রুত গতিতে গাড়ি চলার বিষয়টি সত্য। সব গাড়ি সব সময় গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না জনবল সংকটের কারণে। এ মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতি থাকার কথা ঘণ্টায় ৮০ কিমি। আমরা শুনেছি অনেক গাড়ির গতি আরও অনেক বেশি থাকে। আমরা চেষ্টা করছি সড়ক পরিবহন আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার।
► সারা দেশে আরও দীর্ঘ লাশের সারি
► নিয়ম না মেনে কীভাবে চলছিল বাসটি?
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        