বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
নিয়ন্ত্রণে রেকর্ড ফায়ার সার্ভিসের ৫০ ইউনিট, নিয়োজিত ছিল সেনা বিজিবি পুলিশের বিপুল সদস্য

ভয়ংকর আগুনে ছাই বঙ্গবাজার

মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

ভয়ংকর আগুনে ছাই বঙ্গবাজার

সাড়ে ৬ ঘণ্টার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেট। আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এ পাইকারি মার্কেটের ৫ হাজার দোকান। ঈদের আগে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন হাজারো ব্যবসায়ী। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ আগুনে ছাই হয়েছে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার সামগ্রী। রক্ষা পায়নি পুলিশ সদর দফতরও। গতকাল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে শুরু হওয়া আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় তলব করা হয়েছিল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অগ্নিনির্বাপক ইউনিটকে। লাইফ সেভিং ফোর্সের (ফায়ার সার্ভিস) সদস্যদের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয় সেনা, নৌ, বিমান, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। সবার একাগ্র চেষ্টায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। তবে গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এনেক্সকো ভবনের পাঁচ ও ছয় তলা থেকে থেমে থেমে ধোঁয়া এবং আগুনের ফুলকি বের হচ্ছিল। সান্ত্বনা শুধু এটুকুই যে, আগুনে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায়  বঙ্গবাজার। পরে নতুন করে গড়ে তোলা হয় ওই মার্কেট। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই সেখানে আবার আগুন লাগে। পুড়ে যায় মার্কেটের গুলিস্তান ইউনিটের কয়েকটি দোকান। এবারের ভয়াবহ অগ্নিকা- নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন স্থানীয় ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেই মনে করেন, এটা নাশকতা।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। এখন আর আগুন ছড়াবে না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট কাজ করেছে। তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করতে আরও কিছু সময় লাগবে। প্রতিটি ভবন ও ঘরে গিয়ে আগুন আছে কি না পরীক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এ ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়েছিলাম। ১০ বার নোটিস দিয়েছি,   করণীয় সবকিছুই করা হয়েছিল। তবে মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নয়। এ বিষয়ে অন্য কোনো সংস্থার গাফিলতি থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে আগুন নির্বাপণের পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেটের আগুন দাউদাউ করে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। পর্যায়ক্রমে তা এনেক্সকো, ইসলামিয়া মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুরোপুরি ভস্মীভূত হয় বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট। পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগুনে। আগুনের ঘটনার পরপরই নিরাপত্তার অংশ হিসেবে হাই কোর্ট থেকে গুলিস্তান এবং বঙ্গবাজারসংলগ্ন সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যান চলাচল বন্ধ করা হয় গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া, নাজিরাবাজার, আনন্দবাজার সড়ক থেকেও। সকালে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের কাউকে কাউকে মরিয়া হয়ে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কাঁদছিলেন তাদের অনেকেই। অগ্নিকান্ডের স্থলে ছুটে আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিনসহ সরকারের অনেক দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছিলেন, বঙ্গবাজারের আগুনের সূত্রপাত হয়েছে আদর্শ মার্কেটের দোতলা থেকে। যদিও কোনো সংস্থাই সুনির্দিষ্ট করে আগুনের উৎস সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে আগুন লাগার পরই প্রথমে তা ছড়িয়ে পড়েছিল এনেক্সকো টাওয়ারে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মার্কেটের সঙ্গে বঙ্গবাজারের সামনের রাস্তায়ও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের অধিকাংশ ইউনিটকে সেখানে ডাকা হয়। বহু দূর থেকেও বঙ্গবাজারের আকাশে ধোঁয়ার কু-লী উঠতে দেখা যায়। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকেও আগুনের ওপর পানি ছিটানো হয়।

দোকানিদের নিজের চোখের সামনেই পুড়তে থাকে দোকানগুলো। নীরব দর্শক হয়ে দেখা ছাড়া করার কিছুই ছিল না তাদের। একে একে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হতে থাকে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষের। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছিল বাতাস। উৎসুক জনতার অনেকেই নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ভুক্তভোগী এসব মানুষের অনেকেই রোজার ঈদ সামনে রেখে নিজের সর্বস্বের সঙ্গে এবং আত্মীয়স্বজনের থেকে ধার করে কেউবা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দোকানে বিনিয়োগ করেছিলেন। বঙ্গবাজারের এনেক্সকো টাওয়ারের কাছে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ির সামনে একজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন মিজানুর রহমান। ওই লোক মিজানুর রহমানকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার কান্না থামছিল না। আরাফাত শাড়ি হাউস নামে বঙ্গবাজারে একটি দোকান ও একটি গোডাউন এবং এনেক্সকো টাওয়ারে একটি কাপড়ের দোকান ছিল মিজানুরের। তিনি একটি দোকানের মালও রক্ষা করতে পারেননি।

মিজানুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই আমার সব শেষ! ২ কোটি টাকার ওপরে মাল ছিল। দুই ব্যাংক ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ১ কোটি টাকার ওপর ঋণ আছে।’

ইসলামিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী ইকরাম খান বলছিলেন, ‘তৃতীয় তলায় আমার দুটি বড় শোরুম ছিল। মাল ছিল প্রায় ৮০ লাখ টাকার। সেগুলো পুড়ছে। ঈদ উপলক্ষে মালগুলো তুলছিলাম। আগুনে আমার সব শেষ হয়ে গেলরে ভাই!’

দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবাজারের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষা পুলিশ সদর দফতরে ব্যারাকের চার তলা ভবনে। তবে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে এ শঙ্কায় আগেই সতর্ক ছিল পুলিশ সদর দফতর।

ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, খবর পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে সেখানে প্রথম ইউনিট পৌঁছায়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ইউনিটের সংখ্যা। বাতাসের তীব্রতায় ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে তিনটি প্রতিবন্ধকতা ছিল উল্লেখ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। তার নিজের করা একটি ভিডিও গণমাধ্যমকর্মীদের দেখিয়ে বলেন, ‘কোন জায়গা দিয়ে ফায়ার সার্ভিস কাজ করবে, আপনারাই বলুন। আমরা তো আপনাদের জন্যই জীবন দিচ্ছি।’ ডিজি ফায়ার বলেন, সেনাবাহিনী পানির বাউজার এনে এবং ওয়াসাও পানির বিষয়ে সহায়তা করেছে। আর ঘটনাস্থলে অনেক বাতাস ছিল। বাতাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আগুন চলে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। লালবাগ জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জয়িতা দাস জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণ ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তার স্বার্থে ওই রাস্তাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।

ঈদের আগে স্বপ্ন পুড়ে শেষ

সর্বশেষ খবর