বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঈদের আগে স্বপ্ন পুড়ে শেষ

আরাফাত মুন্না

ঈদের আগে স্বপ্ন পুড়ে শেষ

বঙ্গবাজারে সব হারিয়ে কান্না -জয়ীতা রায়

গতকাল বেলা ১১টা। তখনো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে রাজধানীর বঙ্গবাজারে। নিজের পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন আর রহমান শাড়ি বিতানের মালিক মনজিল আহাদ। জানালেন, সোমবার রাতেও প্রায় ৪ লাখ টাকার মাল ঢুকেছে গোডাউনে। দোকান আর গোডাউন মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকার মালামাল ছাই হয়ে গেছে এই আগুনে। কথা বলতে বলতে হাতে থাকা দোকানের চাবি ছুড়ে মারেন আগুনে, বলেন, এই চাবি দিয়ে আর কী হবে। কাঁদতে কাঁদতে আহাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধুমাত্র এই একটা মাস নিয়েই আমাদের অনেক স্বপ্ন থাকে। এই মাসেই নির্ধারণ হয় সারা বছরের লাভ লসের হিসাব। এবার তো হিসাবের খাতাটাও পুড়ে গেছে।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের সামনের ফুটপাতে নিজের ১০ বছরের মেয়ে হাফসাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন এক্সেসরিজ ওয়ার্ল্ডের মালিক নজরুল ইসলাম। বাবার দোকান পুড়তে দেখে কাঁদছে হাফসাও। কাঁদতে কাঁদতে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা ঈদে মানুষের জন্য নতুন জামা তৈরি করি। এবার হয়তো আমার পরিবারের কেউই নতুন জামা পরতে পারবে না। আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

শুধু আহাদ বা নজরুল নয়, বঙ্গবাজারের এই আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে ৫ হাজারের বেশি ব্যবসায়ীর স্বপ্ন। অনেকে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ধার-দেনা করে মালামাল তুলেছেন দোকানে। কেউ ব্যাংক ঋণ, কেউ আবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে পুঁজি বাড়িয়েছেন। শর্ত ছিল ঈদের পরই টাকা পরিশোধ করবেন। সেই শর্ত হয়তো আর পূরণ করতে পারবেন না অনেকে। ব্যবসায়ীরা জানান, সারা বছর ব্যবসা করে কোনোভাবে দোকান চালিয়ে রাখি আমরা। এই একটা মাসেই আমাদের সারা বছরের লাভ-লসের হিসাব করা হয়। রমজানের এই মাস ব্যবসায়ীদের জন্য সিজন হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবরে ছুটে এসেছেন দোকানদারদের পরিবারের সদস্যরাও। তাদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বঙ্গবাজারের আশপাশের এলাকা।

এই আগুনে স্বপ্ন পুড়েছে দোকান কর্মচারীদেরও। প্রায় ৫০ হাজার কর্মচারী বেকার হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বেতন-বোনাস যেন সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আগুনে দোকান মালিক, কর্মচারীদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিভিন্ন কারখানার মালিকও। নিজেদের পাওনা টাকা আদায় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। জানতে চাইলে ১১৮০ নম্বর দোকানের মালিক আবদুর রহমান বলেন, এই মার্কেটে আমার তিনটি গোডাউন, দুটি দোকান। গত রাতেও (সোমবার রাতে) ১১ লাখ টাকার মালামাল এসেছে। আমি একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সব কিছু শেষ হয়ে গেছে আমার। আমার মতো হাজারো ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেছে এই আগুনে। ফায়ার সার্ভিসের প্রতি দোষারোপ করে তিনি বলেন, প্রথমে বঙ্গবাজারের আদর্শ মার্কেটে আগুন লাগে। এখন ফায়ার সার্ভিস (সকাল সোয়া ১১টা) যেভাবে কাজ করছে, শুরু থেকে যদি এমন গুরুত্ব দিত, তাহলে হয়তো অনেকের দোকানই বেঁচে যেত। আমাদের পরিবারগুলো বাঁচতো। একটা সুতাও দোকান থেকে বের করতে পারি নাই।

নিজের দোকান নেই তবুও কাঁদছেন কারখানা মালিক : ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে প্রায় ১ লাখ পিস শার্ট তৈরি করে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করেছেন শাহী ইমরান নামের কারখানা মালিক। অধিকাংশ টাকাই বাকি। জ্বলন্ত বঙ্গবাজারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনিও কাঁদছেন। তিনি বলেন, শুধু আমি না, অধিকাংশ কারখানা মালিকই সারা বছর বাকিতে মালামাল সরবরাহ করি দোকানগুলোতে। তারা ১৫ রোজার পর থেকে আমাদের টাকা দেওয়া শুরু করেন ১ লাখ ২ লাখ করে। আমরাও এই টাকা নিয়ে আমাদের কারখানার কর্মচারীদের পেমেন্ট দিতে থাকি। ২৮ রোজার মধ্যে সব পাওনা পরিশোধ করে দেন দোকানদাররা। তবে এখন তো তাদেরও সব শেষ, আমাদের পাওনা কীভাবে দেবেন। আমার কারখানায় ৪৫ জন কর্মচারী। আমি জানি না, কী দিয়ে তাদের টাকা দেব। এই টাকা দিয়েই তাদের ঘরে ঈদের বাজার হয়, সেমাই চিনি কিনে নিয়ে বাড়ি যায় তারা। এবার আমার কর্মচারীরা কী নিয়ে বাড়ি যাবে?

ফুঁপিয়ে কাঁদছেন কর্মচারীরাও : দুপুর ১২টায় ফায়ার সার্ভিসের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন ঢাকা ফ্যাশনের কর্মচারী নাসির উদ্দিন। কথা বলছেন, আর তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। জানালেন, দোকান ও পার্টি (সাপ্লাইয়ার) বোনাস মিলিয়ে ঈদের আগে প্রায় লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল তার। এই টাকায় কুমিল্লায় ঘরের মেরামত করবেন। কিন্তু এখন কে দেবে টাকা। মালিকেরও সব শেষ। সঙ্গে তার স্বপ্নও পুড়েছে। নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর আশায় থাকি এই একটা মাস নিয়েই। সারা বছর যা বেতন পাই, তাই দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে। রোজার ঈদের আগে একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা পাই। এই টাকাটা নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা করা থাকে। এবারও ঘরটা ঠিক করার পরিকল্পনা ছিল। তবে তা আর হবে না। ঈদে দুই মেয়েকে নতুন জামা তো আর কিনে দিতে পারব না, হয়তো ভালো খাবারের ব্যবস্থাটাও করতে পারব না। কথাগুলো বলছিলেন আর কাঁদছিলেন নাসির উদ্দিন।

 

বঙ্গবাজারে ভয়ংকর আগুন

(১) দাউদাউ আগুনের ধোঁয়া (২) হেলিকপ্টারে করে আনা হয় পানি (৩) মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন একজন (৪ ও ৫) আগুন নেভানোর চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা (৬) সেনাবাহিনীর সদস্যদের অবস্থান (৭) মানুষের ভিড়ে ব্যাহত হয় উদ্ধার কাজ    -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর