গোপনীয়তা রক্ষা না হওয়ায় গন্তব্য পরিবর্তন করছেন পাচারকারীরা। সুইস ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ তুলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, কেমান আইল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বারমুডার মতো দেশগুলোতে নিয়ে যাচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশিরা বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন। এক বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে বাংলাদেশিরা ১০ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকার সমপরিমাণ সুইস ফ্রাঁ তুলে নিয়েছেন। ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্রাঁ। বর্তমানে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৫২ লাখ ফ্রাঁ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, নির্বাচনের বছর এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ডলারের চাহিদা বেশি হওয়ায় পাচারকারীরা সুইজারল্যান্ড থেকে আরও আকর্ষণীয় গন্তব্যে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। আবার দেশেও ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ বিদেশে পাচার হয় তা মাত্র একটা গন্তব্যে (সুইজারল্যান্ডে) নয়। সুইজারল্যান্ডের মতো আরও অসংখ্য দেশ আছে সেখানে অর্থ পাচার হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। বর্তমানে দুবাইসহ আরব-আমিরাতের দেশগুলো অর্থ পাচারের নতুন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া অর্থ ওইসব দেশেও পাচার হতে পারে। তিনি আরও বলেন, তার মানে এই না যে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার কমে গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর তথ্যমতে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। সরকার যদি মুদ্রা পাচার রোধ করতে পারত, তাহলে বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার জমা হতো। আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিতে হতো না। কাজেই অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা বাড়াতে হবে। যে অর্থ পাচার হয়ে গেছে, সেটা যেন ফেরত আনা সম্ভব হয়। সরকারের সে প্রক্রিয়া জানা আছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, সুইস ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য দেশে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশিরা। আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী অর্থ পাচারের বিষয়ে বিভিন্নজনকে নানা রকম প্রশ্ন করছে। ফলে অনেকেই মনে করছেন তাদের বিষয়ে সুইস ব্যাংকে যোগাযোগ করলে অর্থ পাচারের তথ্য পেয়ে যাবেন। সেটা ভেবে সুইস ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য দেশে নিয়ে গেছেন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশেষ করে দুবাই, কেমান আইল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বারমুডার মতো দেশগুলোতে নিয়ে যেতে পারে। আবার অনেকেই সুইজারল্যান্ডে টাকা পাঠায় সাদা করে দেশে আনার জন্য। চলমান ডলার সংকটের মধ্যে হুন্ডি একটু কঠিন হওয়ার কারণে সেখানে টাকা পাঠানোয় সমস্যা হতে পারে। সরকারের সামনে একটি সুযোগ এসেছে। তিনি আরও বলেন, সুইস ব্যাংকে যাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কমে গেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তদন্ত করার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। নতুন করে কোন কোন দেশে যাচ্ছে সে বিষয়ে তথ্য নিতে পারে। অনুসন্ধান করলে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে হয়তো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে। অর্থ পাচারকারীদের ধরতে এটাও একটা ইতিবাচক দিক হতে পারে সরকারের জন্য। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য গোপন রাখতে পারছে না। কোনো দেশের সরকার চাইলে তার দেশের অর্থ পাচারকারীদের তথ্য দিয়ে দিচ্ছে সুইস ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। আহসান এইচ মনসুর বলেন, তথ্য গোপন না থাকার কারণে অর্থ পাচারকারীরা গন্তব্য পরিবর্তন করেছে। তবে অর্থ পাচার বন্ধ হয়নি। সুইস ব্যাংকে এখন মানুষ টাকা জমা রাখা বন্ধ করে দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, সুইস ব্যাংকের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য চাওয়া হলে তা দিয়ে দেওয়া হয়। সরকার চাইলে তার দেশের অর্থ পাচারকারীদের তথ্য সুইস ব্যাংকের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে। সেই কারণে এখন আর সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখছে না। সুইস ব্যাংকের চেয়ে ভালো ভালো আরও অনেক জায়গা আছে। এসব জায়গার মধ্যে বর্তমানে দুবাই অন্যতম। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে আমাদের দেশের টাকা পাচার হচ্ছে।