বাংলাদেশের রাজনীতি যেন গণভোটের গোলকধাঁধায় আটকে গেছে। গণভোট কখন হবে তা নিয়ে যেমন রাজনৈতিক মতবিরোধ তুঙ্গে। তেমনি গণভোট কীভাবে হবে, তা নিয়েও জনগণের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বিভ্রান্তি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এ বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশে এ আদেশ এবং এর তফসিলে সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হবে।
গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে- আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?
ভোটারদের এ প্রশ্নের উত্তরে ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে নির্ধারিত বাক্সে প্রদান করতে হবে।
তফসিল-১-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কমিশনের আলোচনায় নেওয়া সংবিধানের ৪৮টি সংশোধন প্রস্তাব। গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে এসব সংশোধনী বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযোজিত থাকলেও, চূড়ান্ত তফসিলে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখানেই সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। যে ৪৮টি সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার সবগুলোতে সব রাজনৈতিক দল একমত নয়। বিএনপিসহ অন্তত ১১টি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল এসব সংস্কার প্রস্তাবে। ১৭ অক্টোবর যখন রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তখন এই নোট অব ডিসেন্টগুলো দলিলে উল্লেখ ছিল। নোট অব ডিসেন্ট রেখেই ২৪টি রাজনৈতিক দল এ সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সুপারিশে আপত্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপিসহ যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতে রাজি নয়, তারা কী করবে? বিএনপি সমর্থকরা যদি হ্যাঁ ভোট দেয়, তাহলে তো যেসব বিষয়ে বিএনপি বা সমমনা দলগুলো একমত নয় সেসব বিষয়ও তাদের মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ জোর করে বিএনপিকে হ্যাঁ ভোট দিতে বাধ্য করার একটি প্রতারণামূলক চেষ্টা করা হয়েছে, সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত গণভোটের প্রশ্নটির মাধ্যমে। আবার যদি বিএনপি বা নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত উপেক্ষিত হওয়ায় ‘না’ ভোট দেয় তখন বলা হবে বিএনপি বা না ভোট দেওয়া দলগুলো জুলাই সনদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ আপনি যদি সংসদের উচ্চকক্ষ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি না চান তাহলে শুধু এ বিষয়ে আপত্তি জানানোর কোনো অধিকার আপনার নেই। এ বষিয়ে আপত্তি থাকলে আপনাকে জুলাই সনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। ৪৮টি প্রস্তাবের সবগুলোতে হয় আপনার একমত হতে হবে অথবা নাকচ করে দিতে হবে। ঐক্যের বদলে এ গণভোট বিভক্তির পথ উন্মুক্ত করে দিতে চাইছে। বিএনপি এবং বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করা দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ ভাবে জুলাই সনদের বিপক্ষে অবস্থান নেয় তাহলে কী হবে? এসব ভেবেচিন্তে কি ঐকমত্য কমিশন গণভোটের এমন প্রশ্ন তৈরি করেছে? নাকি তারা চাইছে এ নিয়ে দেশ বিভক্ত হোক, দেশে হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি হোক?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নয় জনগণকেও এ সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে তাদের প্রস্তাব গণভোট করতে বাধ্য করছে। তফসিল-১ এ মোট ৪৮টি প্রস্তাব করা হয়েছে। কজন নাগরিক এ সম্পর্কে জানেন? প্রধান উপদেষ্টা এজন্যই বলেছেন, জুলাই সনদ জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য সবধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘরেঘরে এসব পৌঁছে দিতে হবে। তার আগে এ নিয়ে গণভোট করলে সেটা হবে জাতিকে বোকা বানানো।
এমনিতেই গণভোট নিয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রশাসনিক গণভোট এবং আরেকটি সাংবিধানিক গণভোট। প্রথম গণভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে। দ্বিতীয় গণভোট হয় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে। সবশেষ গণভোট ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। উদ্দেশ্য ছিল সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়া জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা দেওয়া। রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তাঁর নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা আছে কি না, সে বিষয়ে দেশের জনগণের মতামত জানতে ওই গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল।
১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে গণভোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই বছরের ৩১ মে দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে জানা যায়, সারা দেশে ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ৩০ মে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট নেওয়া হয়। ওই সময় দেশে মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সেই গণভোটে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ। এই গণভোট ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেই এত বেশি ভোট দেখে বিস্মিত এবং বিরক্ত হয়েছিলেন। প্রয়াত সাংবাদিক ও গবেষক মাহফুজ উল্লাহ জিয়াউর রহমানের জীবনী গ্রন্থ ‘President Zia of Bangladesh : A political Biography’-এ লিখেছেন “Zia was also surprised by the number of votes cast’ (ভোটের সংখ্যা দেখে জিয়াও বিস্মিত হয়েছিলেন” (তথ্য সূত্র : President Zia of Bangladesh : A political Biography. পৃষ্ঠা-৭১)।
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দেশে দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচি এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য ওই গণভোটের আয়োজন হয়েছিল। আগের মতোই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এই পদ্ধতিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জনগণের আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে ‘না’ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, সেই গণভোটে ভোট পড়েছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এই গণভোটের ফলাফলকে বিবিসি হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য বলেছিল। বিবিসির ঢাকা প্রতিনিধি আতাউস সামাদ বলেছিলেন ‘সারা দিন ভোট কেন্দ্র ফাঁকা থাকলেও ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হলে দেখা যায় ৭২ শতাংশ ভোট’।
গণ আন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। এর তিন মাসের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতির (পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি) সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট মধ্যরাতে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে বিল পাস হয়। ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে গৃহীত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্মতি দেবেন কি না, সে প্রশ্নে দেশব্যাপী গণভোট আয়োজনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
দেশের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত সেই তৃতীয় গণভোটে ভোট পড়ে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮ হাজার ৩৭৭ জন ভোটার সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন। এই হার ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে ৩৩ লাখ ৯০ হাজার ৬২ জন ভোটার ‘না’ ভোট দেন। অর্থাৎ তাঁরা রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। ‘না’ ভোটের হার ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। গণভোটে ৯৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বৈধ ভোটের বিপরীতে বাতিল হয়েছিল শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোট। এই গণভোট বিশ্বাসযোগ্য ছিল বটে কিন্তু অর্ধেকও কম ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছিল। অন্তত ৬৪ ভাগ ভোটারের অনুপস্থিতি ছাড়া এই গণভোট কতটা জনমতের প্রতিফলন সেই নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছিল।
১৯৯১ সালে তৃতীয় গণভোটের আগে গণভোট আইন হয়েছিল। সংসদে পাস হওয়া সেই আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২ক বা ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যবস্থা করিয়া কোনো বিল উক্ত সংবিধানের ১৪২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে গৃহীত হইবার পর উহাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করিবেন কি করিবেন না, এই প্রশ্ন যাচাইয়ের জন্য সংবিধানের ১৪২(১ক) অনুচ্ছেদ মোতাবেক গণভোটের বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ¦ারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।’
২০ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের সেই বিধান বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওই সংশোধনী বাতিলের মামলায় হাই কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি গণভোটও পুনর্বহাল করে রায় দেয়। এখানেও বিতর্ক আছে। গণতন্ত্রে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ-সরকারের তিনটি অঙ্গ স্বাধীন এবং স্বাতন্ত্র্য। একটি বিভাগ আরেকটি বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ না করাটাই গণতন্ত্রের রীতি। এখানে আপিল বিভাগের রায় আপনা আপনি কার্যকর হবে কি না তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
এজন্য সবচেয়ে ভালো এবং বিবেচনা প্রসুত হবে যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। দেশে আগে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। নতুন সংসদ ঠিক করুক জুলাই সনদে কী থাকবে আর কী বাদ যাবে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে কৌশলের গণভোট দেশকে অস্থিতিশীল করবে। জুলাই সনদকেও করবে বিতর্কিত।