শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ দেড় দশকের দুর্নীতি-দুঃশাসন, গুম-খুন, নিপীড়ন-নির্যাতনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল অবরুদ্ধ। গণমাধ্যমের বড় অংশ ছিল স্বৈরাচারের তোষণে ব্যস্ত। অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্রের কাছে ছিল অসহায়। কেউ আবার লড়াই করেছেন অসীম সাহসিকতায়। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশে অবস্থান করেও একদল বাংলাদেশি সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট অকুতোভয়ে লড়ে গেছেন নিজ দেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের মুুক্তির জন্য। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁরা প্রতিনিয়ত বিগত সরকারের দুঃশাসনের নানা চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছেন। বিশ্বব্যাপী নানা ফোরামে তুলে ধরেছেন নিপীড়িত বাংলাদেশিদের কথা। যেসব সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও পরিবর্তনকামী প্রবাসী বিদেশ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী, পিনাকী ভট্টাচার্য, তাসনীম খলিল, ড. কনক সারোয়ার, জুলকারনাইন সায়ের খান সামি, তাজ হাশমীসহ অনেকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন তাঁরাই ভাসছেন সাধারণ মানুষের প্রশংসায়। মেধাবী এসব সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে-বিদেশে ছিলেন আলোচিত মুখ। তাঁদের জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসকের পতনের পথ প্রশস্ত হয়।
অবরুদ্ধ সময়ে আমরা অনেক কিছুই বলতে পারিনি। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে মানুষের বাকস্বাধীনতা যেমন হরণ করা হয়েছিল, তেমন সংবাদপত্রের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ছিল না। সে সময় দেশের গণমাধ্যমকে সরকার বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় ‘দেশবিরোধী ভয়ানক তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। এটিও ছিল বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের চাপিয়ে দেওয়া। এজন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
গত কয়েক বছরে স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনে প্রবাসে অন্যতম আলোচিত মুখ ছিলেন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী। জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট-বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিনের পর দিন উপস্থাপন করে গেছেন তিনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে জানতে চেয়েছেন জাতিসংঘ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। জবাবদিহির আওতায় আনতে চেয়েছেন ক্ষমতাবানদের। দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব। দায়িত্ব পালন করছেন জাস্ট নিউজের সম্পাদক হিসেবে। শুধু প্রশ্ন করেই নিজের কাজ শেষ করেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব সময় সরব থেকেছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন কোটি কোটি গণতন্ত্রকামী মানুষকে। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নানা সেমিনার আয়োজনেও যুক্ত ছিলেন এই সাংবাদিক।পেশায় চিকিৎসক, ফ্রান্সে অবস্থান করা মানবাধিকারকর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য। তাঁর তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর লাখ লাখ অনুসারী রয়েছেন। পিনাকী ভট্টাচার্য বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে একের পর এক ভিডিও বক্তব্য হাজির করেছেন জনগণের সামনে। সরকারের নানা অপকর্মের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রবাসে থাকলেও দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে সব সময় সরব ছিলেন। তাঁর ভিডিও বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অপকর্মের তীব্র সমালোচনা থাকত, যা শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
খ্যাতিমান সাংবাদিক তাসনীম খলিল। সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক। দেশে থাকার সময় ইংরেজি ডেইলি স্টারের হয়ে কাজ করতেন। এ ছাড়া তিনি সিএনএনের স্ট্রিংগার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরামর্শদাতা ছিলেন। গত কয়েক বছরে একের পর এক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কুখ্যাত আয়নাঘরের বিষয়টি নেত্র নিউজই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। গুম, ক্রসফায়ার নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে তোলপাড় তৈরি করে সারা দুনিয়ায়। তাসনীম খলিল ২০০৬ সালে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে সুইডেনে আশ্রয় নেন। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামি ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিলেন কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্র হয়ে। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তাঁর ভাইদের নিয়ে ‘ওরা প্রধানমন্ত্রীর লোক’ আলজাজিরার ওই প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। এরপর একের পর এক নানা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রকাশ করেছেন ভয়ংকর সব তথ্য। প্রকাশ করেছেন বহু গোপন নথি, যা সরকারকে বিপাকে ফেলে দেয়।
সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার ইউটিউব টকশোয় সরকারের মুখোশ উন্মোচন করে গেছেন। এজন্য তাঁর পরিবারের ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি, দমে যাননি। সরকারের দুর্নীতি আর অনিয়মের ঘটনা বারবারই সামনে নিয়ে এসেছেন।
ভুল সংবাদে ক্ষমাপ্রার্থী : আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপের মধ্যে গণমাধ্যমকে কাজ করতে হয়েছে। সাংবাদিকতা অথবা সম্পাদকীয় নীতিমালার পরিপন্থি অনেক খবরই সে সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘দেশবিরোধী ভয়ানক তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিও ছিল বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের চাপিয়ে দেওয়া। এ প্রতিবেদনের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম তিন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য, আবু রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী সুয়েব এবং তাজ হাশমীর ছবি মুদ্রিত হয়। তৎকালীন সরকারের অন্যায় চাপ ও হুমকির কারণে বাংলাদেশ প্রতিদিন এ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। তখন চাপের মুখে আমরা ছিলাম অসহায়। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইন থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। সংবাদটি প্রকাশের দায় আমাদের, কিন্তু তখনকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আমরা মনে করি, বিশিষ্ট অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যসহ আরও অনেকে মুক্তমতের চর্চা করে দেশে বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের এ অব্যাহত সক্রিয়তা দেশে গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়ক হবে। আমরা আমাদের পাঠকের কাছে ভবিষ্যতে কোনো চাপ বা ভীতির কাছে মাথা নত না করে সাংবাদিকতার মহান আদর্শ ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।