ভারতের অর্থনীতিতে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি। গত ৬ বছরের ইতিহাসে তলানিতে এসে ঠেকেছে জিডিপি।
দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে টানা ছয় প্রান্তিক ধরে নিম্নমুখী রয়েছে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। এতে আগামী দিনগুলোয় বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভারতের আর্থিক খাতে সংকট আরও জোরালো হতে পারে। মন্দার মুখে পড়তে পারে দেশটি। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ভারত সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করেছে আর্থিক খাত বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
ভারতের মিনিস্ট্রি অব স্ট্যাটিস্টিক অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেনটেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশটিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর থেকে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমতে শুরু করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা ৭ শতাংশে নেমে আসে। একই অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরো কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। ক্রমাগত পতনের ধারাবাহিকতায় চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর সর্বশেষ প্রান্তিকে দেশটিতে সবচেয়ে কম জিডিপি প্রবৃদ্ধি (৪.৫ শতাংশ) রেকর্ড হয়েছে।
স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় ভারতের প্রবৃদ্ধির গড় হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। তাকে ব্যঙ্গ করে ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’ আখ্যা দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ রাজ কৃষ্ণ। সেই আখ্যা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরই জুলাই মাসে সংসদে আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পাল্টা বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস আমলে অর্থনীতি কেন দ্বিগুণ হয়নি? তখন কেন হিন্দু রেট অব গ্রোথ চাপানো হয়েছিল!’ এবার মোদি জমানাতেই প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসায় প্রশ্ন উঠছে, ‘হিন্দু রেট’ কি আবার ফিরে আসছে?
ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) অর্থনীতির শিক্ষক জয়তী ঘোষের মন্তব্য, ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথে তো তা-ও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার ছিল। এখন কি প্রবৃদ্ধি আদৌ হচ্ছে? নাকি অর্থনীতির সংকোচন হচ্ছে? বেকারত্বের হার, সংসারের খরচ কমে যাওয়া, গাড়ি থেকে নিত্য প্রয়োজনের জিনিসপত্রের বিক্রি হ্রাস, একের পর এক বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার মতো অর্থনীতির অন্যান্য মাপকাঠি কিন্তু সে কথাই বলছে।’
জয়তী মনে করিয়ে দিয়েছেন, মোদি জমানায় জিডিপি মাপার পদ্ধতি বদলে দেওয়া হয়। সেই পদ্ধতি নিয়েই বিতর্ক আছে। বস্তুত মোদি সরকারের সাবেক প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামনিয়াম বলেছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি মাপায় তা ২ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অঙ্ক বেশি দেখাচ্ছে। তাঁর কথা অনুসারে প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত কমে আসার পেছনে উৎপাদন ও চাহিদা খাতের মন্দা ভাব, পর্যাপ্ত বিদেশী বিনিয়োগের অভাব, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকর নীতিকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চাহিদা ক্রমেই কমে যাওয়ার বিষয়টি নরেন্দ্র মোদি সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। অথচ অর্থনৈতিক শ্লথতার পেছনে এটা অন্যতম একটি কারণ। মানুষের চাহিদা বাড়লে উৎপাদন খাত চাঙ্গা হয়ে উঠবে। গতি ফিরবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। নতুবা ভারতীয় অর্থনীতি বড় ধরনের মন্দার মুখে পড়তে পারে।
ইন্ডিয়া টুডে, স্ক্রলডটইন এবং এনডিটিভি অবলম্বনে
বিডি প্রতিদিন/কালাম