এ ছিল এক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এ বিজয় ছিল ছাত্র-জনতার। গত ১৯ দিনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তার দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখো ছাত্র-জনতা রাজধানীর রাস্তায় নেমে পড়েন। অনেকে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে আনন্দ মিছিল করেন।
এ বিজয়কে দেশের আপামর জনসাধারণ ছাত্রজনতার বিজয় হিসেবে দেখছেন। ছাত্র-জনতা একত্রে মাঠে না নামলে এত অল্পদিনে এত শক্তিশালী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করানো মোটেও সহজ ছিল না। সরকারের দমন, পীড়ন, কারফিউ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, আনসার নামিয়েও শান্ত করা যায়নি ছাত্র সমাজকে। এই অসাধ্যকে সাধন করেছে ছাত্র ও জনতা।
সরেজমিন ঘুরে ও ছাত্রজনতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৬ বছরের হত্যা, খুন, গুম, লুটপাট, সীমাহীন দুর্নীতির অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছে শুধু তাদের সাহসিকতার কারণে। ফলে এটা ছাত্র জনতারই বিজয়। আন্দোলকারীদের মধ্যে শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অন্যায়-অনিয়ম আর দুর্নীতি করে মানুষকে বোকা বানিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। গত ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনা যে দুঃশাসনের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তার সমুচিত জবাব দিয়েছে ছাত্র সমাজ। কোনো আন্দোলনই ছাত্রদের বাদ দিয়ে সফলতার মুখ দেখেনি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই ছাত্র সমাজ বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশটাকে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন করল এই ছাত্র সমাজ। এখন থেকে যেই ক্ষমতায় আসুক, অন্যায়, অনিয়ম করতে ভয় পাবে বলে তিনি মনে করেন।
কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন তুঙ্গে উঠে পুলিশের গুলিতে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ। এই দাবি নিয়ে সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠে ছাত্রজনতার স্বতঃফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশকে তুচ্ছ করে রাস্তায় নেমে পড়েন ছাত জনতা, অভিভাবক। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দেন সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, নাহিদ ইসলামরা। তরুণ এই ছাত্র সমাজ সারা দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র হত্যার বিচারের দাবিতে। এরপর নির্বিচারে গুলি করে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ হত্যার বিচার ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে অহসযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার দ্বিতীয় দিনের মাথায় এ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি সরকার। এই আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয় পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের মতো এতবড় দলের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থককে ফেলে দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে রওনা দেন। এ সময় শহরের প্রধান প্রধান সড়ক এমন কি অলিগলিতে নেমে পড়েন সাধারন মানুষ। সারা শহরের সব মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করতে থাকেন। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর গণভবনে প্রবেশ করেন ছাত্র-জনতা। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় গত দেড় দশক গণভবনেই ছিলেন তিনি।
আরেক আন্দোলনকারী আফিয়া বিনতে জামান বলেন, এতবড় এবং প্রাচীন রাজনৈতিক দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে ফেলে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। তার মানে তিনি জনগণের ভয়ে পালিয়ে গেছেন। ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে তাদের বুকে গুলি চালিয়ে কোনো সরকারই কখনো ক্ষমতায় থাকতে পারে না। এবারও পাারেনি। তিনি পালিয়ে যাওয়ার আগে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেও যেতে পারেনি। এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি এটা তার কৃতকর্মের ফল।
এই বিজয় উল্লাসে যোগ দিয়ে বশির আহমেদ নামের ৬৮ বছর বয়সি এক মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে গতকাল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ছাড়া ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবই তো দেখে এসেছি। সে সব আন্দোলন করেছিও। কিন্তু এবারের আন্দোলনের তীব্রতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। ছাত্ররা নেতৃত্বও দিয়েছে অসাধারণভাবে। দেশটাকে নতুন করে গড়তে এদের মতো মেধাবী ছেলেদের কাজে লাগাতে হবে বলে তিনি মনে করেন। গণভবনে ঢুকে উল্লাসে ফেটে পড়েন জনতা। অনেকেই ছবি ও ভিডিও করে তা ফেসবুকে পোস্ট করে। সেখানকার পুকুরের মাছ, গরু, হাস-মুরগি, কবুতর, ছাগল, বিছানা, বালিশ, তোষক, পোশাক-আশাক নিয়ে চলে যায় ছাত্রজনতা।