ব্যাপক পরিবর্তন আসছে পুলিশে। জনমানুষের কাছে আস্থা ফেরাতে এরই মধ্যে দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন পুলিশের কর্মরত এবং সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই স্পেশাল ব্রাঞ্চ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ-(সিআইডি), রেঞ্জ, মহানগরসহ বিভিন্ন ইউনিটে নতুন কর্মকর্তা পদায়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে শুধু সাম্প্রতিক ইস্যু নয়, ভবিষ্যতেও পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার থেকে দূরে রাখার জন্য ফের কমিশন গঠনের দিকে যাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে নতুন লোগো এবং ইউনিফর্মের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৭ সালে তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদের আমলে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন নিয়ে কাজ শুরু হয়। অর্থায়ন করে ইউএনডিপি। প্রায় দেড় বছরে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে একটি খসড়াও তৈরি করেন। খসড়ায় কমিশনের দুটি ইউনিট রাখা হয়। একটি ইউনিটের দায়িত্ব ছিল অভিযোগের তদন্ত। অন্যটি ছিল পদায়ন এবং পদোন্নতির বিষয় দেখভাল করা। কমিশনে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চাকরিরত কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা আলোর মুখ দেখেনি।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় ৭২ ঘণ্টা পুলিশ মাঠে ছিল না। ডিএমপিসহ (ঢাকা মহানগর পুলিশ) দেশের অধিকাংশ থানা ছেড়ে চলে যায়। এর বিপরীতে কাজ করেছিল দীর্ঘদিন পুলিশের অপকর্মের জন্য সাধারণ মানুষের মাঝে তৈরি হওয়া ক্ষোভ, বাহিনীর অধস্তনদের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, নিরাপত্তার অভাব ও মনোবল হারানো। বাহিনীর শীর্ষ কর্তারাও দিয়েছিলেন গা-ঢাকা। তবে এরই মধ্যে বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে আইজিপি হিসেবে মো. ময়নুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হিসেবে মো. মাইনুল হাসান, র্যাব মহাপরিচালক হিসেবে এ কে এম শহিদুর রহমানকে নিয়োগ দেয় সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে পুলিশের ভিতরে ব্যাপকভাবে দলীয়করণের বিরূপ প্রভাব পড়েছে এই বাহিনীতে। বড় একটি অংশের মধ্যে পদোন্নতি না পাওয়ার ক্ষোভ আছে। কেউ অতিউৎসাহী হয়ে দফায় দফায় বেআইনি এবং অপেশাদার কাজ করলেও বহাল তবিয়তে ছিলেন তারা। উল্টো অনেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন। বর্তমান সরকারও যদি পুলিশ কমিশন গঠন করতে চায় আবারও রাজনৈতিক মহল থেকে বাধা আসতে পারে। কারণ তারা চাইবেন না তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাক। এদিকে, বেশ কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধস্তন কর্মচারী সংগঠন’। গত রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। বৈঠক শেষে রাতেই কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যরা। পরবর্তীতে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, শিগগিরই পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে। সব মিলিয়ে পুলিশ সদস্যদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এম সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করা যাবে না। পুলিশের হাতে দেওয়া হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্র। তাদের এ অস্ত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। পুলিশ নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন বিশ্লেষক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন পুলিশের কিছু কর্মকর্তা। এখন যদি তারা কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন তাহলে অসম্মানজনক আচরণ পেতে পারেন, এমন শঙ্কা কারও কারও। অগ্নিকান্ডের পর স্থাপনার যে ধরনের ক্ষতিসাধন হয়েছে, মোটামুটি সংস্কার না করলে সেখানে বসে অফিস করা সম্ভব নয় বলে জানান এক পুলিশ সুপার। আরেক জেলার পুলিশ সুপার জানান, কম্পিউটারসহ নতুন সরঞ্জাম কিনে নতুনভাবে থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পুলিশের চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনীতিবিদরাই পুলিশকে অপরাধ কর্মে উৎসাহিত করেছেন। তাদের অনেকে পুলিশকে অতিরিক্ত বল প্রয়োগে বাধ্য করেছেন। এ প্রভাব থেকে বাহিনীকে মুক্ত রাখতে আমরা ২০০৭ সালে পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তবে আমরা এর বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কি আদৌ এর বাস্তবায়ন করতে পারবে? পাকাপোক্তভাবে যদি এটা করতে পারে তাহলে খুব ভালো একটা কাজ হবে। সাধারণ মানুষ এর থেকে উপকৃত হবে। জবাবদিহির মধ্যে থাকবে পুলিশ। এদিকে গতকাল দিনভর চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে প্রতিবাদ করতে থাকেন। তাদের দাবি ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং রাজনৈতিকভাবে তাদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরে রাত ৮টার দিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন তাদের শিগগিরই চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এ নিয়ে কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি। এর আগে গত রবিবার রাতে ১১ দফা দাবি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেছিলেন, আমরা সরকারের কাছে যেসব দাবি জানিয়েছিলাম তার বেশির ভাগ মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাই আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছি। পুলিশ নিয়ে একটি স্বাধীন কমিশন হওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।