আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর সক্রিয় হয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ও কোণঠাসা থাকা কর্মকর্তারা। দফায় দফায় বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছে যাচ্ছেন তারা। কাউকে ঘেরাও করছেন, কারও কাছে বৈষম্য হওয়ার কথা তুলে ধরছেন। নানা কারণে পদোন্নতিবঞ্চিত ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাডার পরিবর্তন করে প্রশাসনে আসা কর্মকর্তারাও রয়েছেন এতে। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বঞ্চিতদের কথা শুনছেন, যৌক্তিক ন্যায় পাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন।
এনিয়ে কয়েক দফায় বিভিন্ন কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের অভিযোগ বলেছেন এবং আশ্বাসও পেয়েছেন।
জানা গেছে, বিভিন্ন ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের বাইরে অন্য ক্যাডার থেকে আসা অন্তত আড়াই শ কর্মকর্তা এমন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকেই দীর্ঘদিন পদোন্নতি না পেয়ে জুনিয়রদের অধীনে কাজ করছেন। ইতোমধ্যেই পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারব্যতিত বিশেষজ্ঞ ২৫ ক্যাডারের ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের উপসচিবরা সরকার পরিবর্তনের পর তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামে। ক্যাডার নির্বিশেষে বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ার লক্ষ্যে প্রশাসন ক্যাডারব্যতিত বিশেষজ্ঞ ২৫ ক্যাডারের ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের উপসচিবদের পদোন্নতি প্রদানের দাবি তুলে মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। ট্যাক্স ক্যাডার থেকে উপসচিব হওয়া ১৮ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. নাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের এক দফা। সেটি হলো, উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব হতে যারা যোগ্যতা অর্জন করেছে একই আদেশে পিএসসির ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দিতে হবে। অন্যথায় আমাদের অনশন শুরু হবে। আমাদের হারানোর কিছু আর নেই। ক্যাডার পরিবর্তন করে প্রশাসনে আসা ২১ ব্যাচের কর্মকর্তা জিহাদ উদ্দিন বলেন, আমরা সিনিয়র সচিবের সঙ্গে দেখা করেছি। আইনটা শুধু ফলো করতে অনুরোধ করেছি। যাতে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি হয়। এখন যারা বঞ্চিত তাদের ভূতাপেক্ষ প্রমোশন দিতে হবে। এদিকে গতকাল সারা দিন উত্তপ্ত ছিল জনপ্রশাসনের প্রতিটি আঙিনা। সর্বত্রই বঞ্চিতদের পদচারণা দেখা যায়।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা কয়েক দফায় এপিডি উইংয়ে যান। পরে দুপুরের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে দেখা করেন তারা। তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন বঞ্চিত অন্যান্য ক্যাডার থেকে হওয়া উপসচিবরা। তাদের দুঃখ-বঞ্ছনা শুনে সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ? উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আপনাদের দাবির সঙ্গে আমি একমত। তবে আমরা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। সে আলোকে দ্রুতই ভালো সমাধান হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
পদোন্নতিবঞ্চিত উপসচিবরা বলেন, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, ‘যখনই কোনো কর্মকর্তা ২০০২ সালের বিধিমালা অনুসারে উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা যে কোনো ক্যাডার হইতেই হউক না কেন, তিনি তখন একজন পরিপূর্ণ উপসচিব। তাহার পূর্বের ক্যাডার পরিচয় তখন বিলুপ্ত হইবে। সচিবালয়ের উচ্চতর উপসচিব পদে তখন তিনি অধিষ্ঠান। সেই অধিষ্ঠান লইয়াই অন্য সকল উপসচিবের সহিত একশ্রেণিভুক্ত হইয়া সমঅধিকার লইয়া তিনি পরবর্তী উচ্চতর যুগ্মসচিব পদে বা পরবর্তীতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হইবার জন্য বিবেচিত হইবেন।’ অথচ এসএসবি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ আদালতের উপরিল্লিখিত পর্যবেক্ষণও আমলে নিচ্ছে না। যদিও আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন সচিব। তিনি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, যে কোনো কারণেই হোক যেহেতু এতদিন হয়নি, আমরা এখন থেকে এসব নিয়ে কাজ করছি। যাতে যোগ্যরা বাদ না যায়। এর পরও বিভিন্ন ক্যাডার থেকে পদবঞ্চিত কর্মকর্তারা সচিবের সঙ্গে দেখা করে তাদের মনোকষ্টের কথা তুলে ধরেন। কেন তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে সেসব বিষয়েও আলোকপাত করেন অনেকে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি পাননি। শুধু প্রশাসন ক্যাডারেই সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হবেন এমন বঞ্চিত কর্মকর্তা আছেন ১১২ জন। উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব হতে বঞ্চিত কর্মকর্তা ১৭১, যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব বঞ্চিত আছেন ৮৬ কর্মকর্তা। এর বাইরেও অন্যান্য ক্যাডার থেকে প্রশাসনে মার্জ হওয়া ২৫০ জন কর্মকর্তাও আছেন নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবিতে।
এদিকে গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অফিস করতে এলে প্রায় সব অতিরিক্ত সচিবকেই রুম থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই আগের এপিডি সরিয়ে নতুন এপিডি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এদিন অফিস করতে এলে অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানাকে বের করে দেন জুনিয়র কর্মকর্তারা। রুমে প্রবেশ করতে না দিয়ে বরং তারা বলতে থাকেন, আপনি এক সময় আমাদের কোনো কথা শোনেননি। প্লিজ চলে যান। আরেক অতিরিক্ত সচিব তাকে রক্ষায় এগিয়ে এলেও সেখানেও বসতে দেয়নি তাকে। এর পর তিনি অফিস থেকে চলে যান। ওই সময় জুনিয়র একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এক সময় উনি ক্ষমতা দেখিয়ে নিজের লোকদের ভালো জায়গায় পদায়ন করেছেন। বহু কর্মকর্তাকে বিনা কারণে বঞ্চিত করেছেন। একইভাবে অফিসে এলে বিভিন্ন সময় বঞ্চিত কর্মকর্তারা জোটবেঁধে অফিস করতে দেননি অতিরিক্ত সচিব ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হক, আমেনা বেগমসহ অন্য কর্মকর্তাদের। আগের সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করা উপসচিব, যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও রুম থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ সময় অনেক জুনিয়র কর্মকর্তা সিনিয়রদের সঙ্গে উগ্র আচরণও করেন বলে জানা গেছে।