আজ ২৪ নভেম্বর। ২০১২ সালের এই দিনে সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১৪ জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনার ৪ বছরেও এই ট্রাজেডিকে হৃদয় থেকে ভুলতে পারেনি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবার। এখনও তাদের তাড়া করে বেড়ায় স্বজন হারানোর বেদনা। আছে পঙ্গুত্ব বরণ করা সদস্যদের নিয়ে নিদারুণ কষ্ট।
এদিকে তাজরীন ট্রাজেডির চার বছর পূর্তি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহতসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাজরীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির প্রধান ফটকের সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাজরীন গার্মেন্টস সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের সব ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিককে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ ও মালিক দেলোয়ার হোসেনের কঠোর শাস্তি দাবি করেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে তাজরীন কারখানায় গেলে দেখা যায়, প্রধান ফটকটিতে তালা ঝুলে আছে। ভাঙা জানালার গ্লাসগুলো তাকিয়ে আছে সড়কের দিকে। কর্মচঞ্চল ভবনটি এখন রূপ নিয়েছে ভুতড়ে বাড়িতে। ভবনটির চারপাশের দেয়ালেই গজাতে শুরু করেছে ছোট ছোট গাছ। এ যেন এক প্রচীন ভবন। ভবনটির বাহিরে অবস্থান করতে দেখা গেছে সেদিনটিতে ভবনের ভেতরে থাকা কয়েকজন শ্রমিককে। কথা হয় তাদের সাথে।
এদেরই একজন লিয়ন আহম্মেদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ''আমার পরিবারের বাবা-মা, ভাই-ভাবিকে হারিয়ে নিঃস্ব প্রায়। এখন আমি ২ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় বোনের সাথে থাকি। মা-ভাইয়ের মৃতদেহ পেলেও বাবা-ভাবির মৃত দেহটি মেলেনি। সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান পেলেও একটিবারের জন্যও ভুলতে পারছেন না তাদের স্মৃতি। মনে হয় এই বুঝি বাবা আমাকে ডেকে বলছে আমাকে বাঁচা। এ যে কি যন্ত্রণা তা বলে বুঝানো যায় না।''
আয়শা পারভিন নামের আরেকজন বলেন, তখনকার সহকর্মীদের বাচাঁর আকুতি এখনো কানে ভেসে উঠে। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদে। শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার বলেছে যতদিন বেঁচ থাকবে এভাবেই বাচঁতে হবে। এক সময়কার কর্মক্ষম ছিলেন, এখন অক্ষম হয়ে বেঁচে আছি। অভাবের সংসারে বুঝা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এর চেয়ে মৃত্যু ভালো।''
আগুনে নিহত ও আহত শ্রমিকদের সরকার ও বিজেইএমই পক্ষ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও এখনও অনেক শ্রমিকের অভিযোগ করেন তারা ওই সব ক্ষতিপূরণ পায়নি।
আসলাম মিয়া আর জাহানারা বেগম জানান, ঘটনার পর নিজের চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ঘটনার পর কোথাও থেকে একটি টাকাও তারা পাননি। এই দম্পতি অভিযোগ করেন, অনেকে মিথ্যা নাম দিয়ে টাকা তুলেছে আর তারা প্রকৃত ভক্তভোগী হয়েও কোন টাকা পাননি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন ফায়দা হয়নি তাদের। এখন সবই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তারা।
অপরদিকে তাজরীনের আগুন থেকে প্রাণে বাঁচতে গিয়ে শাহানাজ বেগম (৪০) লাফিয়ে নিচে পড়েন। তিনি ফিনিশিং শাখায় অপারেটরের কাজ করতেন। তবে প্রাণে বাঁচলেও তার ডান চোখের ভেতর দিয়ে রড ঢুকে যায় আর বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। অগ্নিকাণ্ডের পর বিজিএম থেকে এক লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে বেশ কিছু দিন চিকিৎসা করাতে পারলেও এখন চিকিসৎসা তো দূরের কথা নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
তিনি আরও বলেন, আগুনের হাত থেকে সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ডান চোখ অন্ধ ও ডান পা ভেঙে যায়। এরপর স্বামী জাবেদও তাকে ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করে। গ্রামের জমি বিক্রি করে কোন রকম বেঁচে আছেন তিনি। নিজের দুই সন্তান গ্রামের বাড়িতে তার ছোট বোন আমিনার কাছে থেকে পড়াশুনা করছে। তাদের পড়াশুনার খরচ তার ছোট বোনই বহন করে। তাজরীনের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড তার জীবনকে এখন অনিশ্চিয়তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এদিকে, যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে তাজরীন গার্মেন্টস এর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প আশুলিয়ার থানা কমিটির সভাপতি মো. সরোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তাজরীন ফ্যাশনের আগুনে পুড়ে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়ে সন্ত্বোষ প্রকাশ করে বলেন, একটু দেরিতে হলেও সরকার ও বিজিএমইএ নিহত ও আহত শ্রমিকদের টাকা পরিশোধ করেছেন। যা ধন্যবাদের দাবিদার। তবে যেসকল শ্রমিক আহত হয়ে আছে, তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে পূর্ণবাসন করলে সেসব শ্রমিকরা ভয়কে জয় করে নতুন করে বাঁচতে পারতো। তাই সরকার দ্রুত আহত শ্রমিকদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।
বিডি-প্রতিদিন/২৪ নভেম্বর, ২০১৬/মাহবুব