রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

আবাসিকের চেহারা নেই ওয়ারীতে

শ্যামপুর টু লালবাগ ৫

মাহবুব মমতাজী

আবাসিকের চেহারা নেই ওয়ারীতে

বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর গড়ে ওঠা আদি ঢাকা শহরের প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ওয়ারী থানা এলাকা। ঢাকার প্রাচীন বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান বলধা গার্ডেনও এখানে অবস্থিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে চকবাজার, বাংলাবাজার, নবাবপুর প্রভৃতি এলাকায় নাগরিক বসতির পত্তন ঘটে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে এর বিস্তার ঘটে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তাগিদে। ওয়ারী থানা এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮, ৩৯ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। এখানে রয়েছে পুরনো সলিমুল্লাহ     কলেজ ও গ্রাজুয়েটস স্কুল। আবাসিক এলাকা বলা হলেও রয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আর ময়লা- আবর্জনায়ও আছে চরম অব্যবস্থাপনা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষ দিকে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে। বর্তমান ওয়ারীর খাসজমি পত্তন দিয়ে জনবসতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় ওয়ারীর ছয় ভাগের পাঁচ ভাগই ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। ১৮৮৪ সালে ঢাকার রাজস্ব প্রশাসক বা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ছিলেন ফ্রেডরিক ওয়্যার। তিনি জনবসতি স্থাপনের লক্ষ্যে পুরো এলাকাটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেন। তার উদ্যোগে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়। এসব ছিল লাল সুরকি বিছানো পথ। এ ছাড়া রাস্তার দুই পাশে তৈরি করা হয় ড্রেন। তৈরি করা হয় পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড পানির ট্যাঙ্ক বা রিজার্ভার। মূলত ফ্রেডরিক ওয়্যারের নামানুসারেই এ আবাসিক এলাকাটির নামকরণ হয়েছিল ওয়ারী। প্রথমে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিনামূল্যে আবাসিক প্লট বরাদ্দ করা হয়। এতে শর্ত দেওয়া হয় যে তিন বছরের মধ্যে বসতবাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করতে হবে। এমনকি বাড়ির নকশা অনুমোদনেরও শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। তৎকালীন ঢাকার সুন্দর ছিমছাম নিরিবিলি একটি আবাসিক এলাকা হয়ে উঠেছিল ওয়ারী। এ এলাকার পূর্বপাশ অভিজাত হিসেবে এখনো টিকে আছে। আর পশ্চিম পাশ পরিণত হয়েছে অপরিকল্পিত পুরনো ভবন আর আবর্জনাপূর্ণ এলাকায়।

জানা যায়, ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার ৪২তম থানা হিসেবে ওয়ারী থানার কার্যক্রম শুরু হয়। সূত্রাপুর থানাকে ভেঙে ১.৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ওয়ারী। উত্তরে গোপীবাগ কাঁচাবাজার হয়ে কিশোরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড ও হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ। দক্ষিণে রায়সাহেব বাজার হয়ে ধোলাইখাল রাস্তা। পূর্বে দয়াগঞ্জ রেলক্রসিংয়ের মাঝের রাস্তা হয়ে স্বামীবাগ রেলক্রসিং। আর পশ্চিমে নবাবপুর রোড হয়ে রায়সাহেব বাজার ক্রসিং নিয়ে গঠিত ওয়ারী থানা এলাকা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে শাহ সাহেব লেন। এটি ওয়ারীর অন্যতম পরিচিত একটি সড়কের নাম, যার এক পাশে সাধু যোসেফ কারিগরি বিদ্যালয় আর অন্য পাশে কেবলা শাহ আহসান উল্লাহ মাজার শরিফ। ওয়ারী থানা মোড় থেকে স্বামীবাগ সংযোগকারী সড়কটি কাদা-মাটি আর খোঁড়াখুঁড়ি করে রেখে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। নেই কোনো মেরামতের উদ্যোগ। তাই এ পথে পায়ে হেঁটে চলাচলই একমাত্র মাধ্যম। ২৭ নম্বর দক্ষিণ মৈশুন্দী সড়কটিও বেহাল হয়ে আছে প্রায় বছর খানেক ধরে। এর ড্রেনগুলোতে নেই কোনো ঢাকনা। একটু বর্ষাতেই ড্রেনের ময়লা কালো পানিতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। চরম বিড়ম্বনা নিয়ে চলাচল করতে হয় সাধারণ মানুষকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওয়ারী পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হলেও এর টিপু সুলতান রোডের ১৫/৮ নম্বর বাড়িটি একতলা থেকে দোতলায় পরিণত করা হচ্ছে কোনো ধরনের নকশা অনুমোদন ছাড়াই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ময়লা-আবর্জনার চরম অব্যবস্থাপনা। একই বাড়ির ঠিক উল্টোপাশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সৌজন্যে স্থাপিত ডাস্টবিন। কিন্তু সেখানে না ফেলে আশপাশ ভরে ফেলা হচ্ছে গৃহস্থালীর আবর্জনা দিয়ে। এ ছাড়া টিপু সুলতান রোড, গোয়ালঘাট লেন ও লালমোহন সাহা স্ট্রিটের মোড়টির তিন ভাগের এক ভাগ ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। এর ফলে সকাল-বিকাল সৃষ্টি হয় যানজটের।

জানা গেছে, বর্তমানে ওয়ারী এলাকাটি পরিকল্পিত আবাসিক, অপরিকল্পিত আবাসিক ও শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। গৌর নিতাই সাহা স্ট্রিটের বিক্রমপুর নূরানী আয়রন মার্কেটের সামনের এলাকায় পানি সংকট নিরসনে বসানো হয়েছে কল। সেখানে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিনভর গোসল এবং রাত ১০টার পর কাপড় ধোয়ার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বনগ্রাম রোডটি পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৪ নম্বর বাড়ি এবং বায়তুন নূর জামে মসজিদের সামনে প্রায় ২০ মিটার অন্তর তিনটি ময়লার বড় স্তূপ রাখা হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এখানে নেই কোনো ডাস্টবিন। নেই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুদৃষ্টি।

ফ্রেডরিক ওয়্যারের স্বপ্নের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা এখন প্রায় বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক ও শিল্প এলাকায় পরিণত হয়েছে। এখানে আবাসিক জনপদের বদলে গড়ে উঠেছে স্বনামধন্য বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শো-রুম, রেস্টুরেন্ট। আবাসিক এলাকা বলা হলেও ওয়ারী ও আশপাশে প্রায় আট হাজার ছোট-বড় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই প্রাচীন একতলা কিংবা দোতলা জরাজীর্ণ রংচটা ভবনে স্থাপিত, যেখানে চাপাচাপি পরিবেশে ঝুঁকির মধ্যে ভারী মেশিনপত্র চালানো হয়ে থাকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট জায়গার অভাব। অল্প জায়গার মধ্যে বড় বড় মেশিন বসিয়ে ঝুঁকি নিয়ে কারখানা চালাতে হয়।’

এসব বিষয়ে জানতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু আহমেদ মন্নাফীর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর