বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হুদাই কুদায় মাতা কন্যা বধূ জায়া ভগ্নিরা

মোস্তফা কামাল

হুদাই কুদায় মাতা কন্যা বধূ জায়া ভগ্নিরা

আঠারোর আগে বিয়ে নয়, কুড়ির আগে মা নয়— আমাদের প্রত্যয়ভরা এ স্লোগানটাকে নিরর্থক করে দেওয়া হলো আরেক ডোজ। একেবারে আইন মতো। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে রাখা হয়েছে, বিশেষ ক্ষেত্রে আগাম বিয়ের বিধান। আইনটির ১৯ ধারার বরকতে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে বৈধ। এর ফজিলতে বাল্যবিয়ে আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা থাকলেও নারীকুল মোটামুটি নিশ্চুপ।

আসলেই কি তারা জাগাইলেও জাগেন? চেতনায় চেত আসে? বুঝেন আসলটা?  এটাই তবে বাস্তবতা? মোক্ষম ইস্যুতে তারা হৈচৈ কমই করেন। চেত বেশি মামুলি ব্যাপারে। 

এর মধ্যেই ছাত্রলীগের সোনার টুকরা বদরুলের কোপে ক্ষতবিক্ষত পুণ্যভূমি সিলেটের খাদিজা যমের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ফতোয়া, এসিড, পাচার, অপহরণ, নিখোঁজ, যৌতুকের বালামসিবতও চলছে সমানে। গরম খুন্তিতে মুখে কাজল পরছে মর্জিনাদের। ময়নাদের ময়নাতদন্তে মিলছে স্ট্রোকে ইহলোক ত্যাগের আলামত। মাত্র কদিন আগেই না কুমিল্লায় ভালুকের ধর্ষণে মারা গেছে তনু। মেয়েটা নাকি আজেবাজে কাজ করত বহুজনের সঙ্গে। অর্থাৎ উচিত বিচার হয়েছে। কেউ কেউ বলে চট্টগ্রামে মিতুকে মারিয়েছে তার এসপি স্বামী! মিতুর চরিত্রেও গোলমাল ছিল বলে প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে। মরার এবং মারার পরও শাস্তি!

এভাবে আজ রোকেয়া, কাল রেশমা, পরশু সুমাইয়া। কটা দিন বিচার চাই, বিচার চাই চেঁচানি ছাড়া এ নিয়ে নেত্রীদের কার্যকর কোনো আওয়াজ কি আছে? মাঝেমধ্যে মানব-মানবী মিলে মানববন্ধনের নামে শোডাউন ছাড়া? প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত গান/কবিতা জাগো নারী-তে নারীদের জাগানোর চেষ্টা করেছেন বহ্নি-শিখা, দাহিকা, ধূমায়িত অগ্নি, স্বর্গ-স্খলিতা, জয়ন্তিকা ইত্যাদি কত সোহাগী সম্বোধনে। পেরেছেন কি তাদের পটিয়ে-পাটিয়ে হলেও প্রকৃত অধিকারের ব্যাপারে বোধ-বুদ্ধি জাগাতে? নারীমুক্তি যে মানবতার মুক্তি আজ পর্যন্ত সেই ভাবটা কি খোলাসা করেছেন নারীরা? নাকি নারীমুক্তির আওয়াজে পুরুষবন্দীর আতঙ্ক ছড়িয়ে চলছেন?

নারী বিষয়ে আমার লেখালেখি একদম নেই। পড়াশোনাও কম। যদিও নারীবিষয়ক সাহিত্যসহ সৃষ্টিকর্মের বাজার ভালো। পাঠক, দর্শক, শ্রোতা প্রচুর। আমি সেখানে বড় নিঃস্ব। একসময় সিগারেটের বিজ্ঞাপনে মেয়েদের অপব্যবহারে কষ্ট পেয়ে এক মডেলকেই বলেছিলাম, নারীদের অপমানের কথাটা। তিনি ভীষণ মাইন্ড করেছেন আগুনমুখী হয়ে। খেয়াল করেছি, অপব্যবহারের পণ্যতেই কী গর্বিত তিনি। পরে সেই কষ্ট একেবারে থমকে দিয়েছে ব্লেডের বিজ্ঞাপনেও নারীর ব্যবহার।

এ লেখাটি লিখতে গিয়ে নারী বিষয়ে কিছু তথ্য-সাবুদ জোগাড় করতে হয়েছে। ঘটনাচক্রে কয়েকটি গবেষণা রিপোর্টেও চোখ বুলাতে হয়েছে। তা করতে গিয়ে শিক্ষায় বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতিকে মনে হয়েছে বড়াই করার বিষয়। নারীর ক্ষমতায়নও গর্বের ব্যাপার। এর বিপরীতে ঠকাঠকির কিছু কায়কারবারও যে পেয়েছি! জিততে গিয়ে কি হারে ঠকছেন তা বললে তো ক্ষেপে যাবেন মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নিরা। বোঝা দূরে থাক, শুনতেও চাইবেন না। কিছু কেস স্টাডিতে পেয়েছি, তারা নিজের পাতে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তুষ্টি পান। নিজেকে বিজয়ী ভাবেন। স্বস্তি পান মানুষ না হয়ে মেয়ে মানুষ হতে। ম্যান হবেন কেন ওম্যানরা? ব্যাকরণেও তা বেমানান। বুঝদার পুরুষরা এ সুযোগটাই নেন। কৌশলে তারা যন্ত্রণা দেওয়া নারীকে ভোগান রাজ-বেদনায়। অর্ধাঙ্গকে দাস বানিয়ে রাখায় সচেষ্ট নারীরা তখন নিজেই হয়ে যান দাসের দাসী।

হাজব্যান্ড শব্দটির অর্থ যে পালনকারী তার বিরুদ্ধে কোনো নারী কি আজ পর্যন্ত শক্ত আপত্তি করেছেন? অভিধানে নারী শব্দটির প্রতিশব্দগুলোর মধ্যে একটি ভার্যা। এর অর্থ ভরণীয়া। অর্থাৎ যাকে ভরণ করাতে হয়। ভৃত্য এবং ভার্যা শব্দ দুটির উত্পত্তিগত অর্থ একই। আজ পর্যন্ত কোনো নারী এর প্রতিবাদ করেছেন বলে জানি না। শুনিওনি। এছাড়া, যুগে যুগে করা অশালীন মন্তব্যে বধূ, জায়া, ভগ্নিরা নাখোশ হয়েছেন এমন তথ্যও কম। বাধ্য হয়ে এখানে সেরকম কয়েকটি মন্তব্য উল্লেখ করছি। যেমন—

১) মেয়ের সম্মান মেয়েদের কাছেই সবচেয়ে কম। ... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২) বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের চুইংগামের মতো চাবাতে ইচ্ছে করে। ... অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ

৩) কম বয়েসী মেয়ে হলো রসগোল্লার মতো, যেখানে রাখবে সেখানেই পিঁপড়ে ধরবে। ...শংকর

৪) পৃথিবীতে বা সমুদ্রে যতো হিংস্র প্রাণী আছে, সবচেয়ে বৃহত্তম প্রাণী হল মেয়েরা। ...মেনানডার

৫) পুরুষেরা মেয়েদের খেলার সামগ্রী এবং মেয়েরা শয়তানের খেলার সামগ্রী। মেয়েরা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বৈ কিছু নয়। ...নেপোলিয়ান

৬) মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললেই তো পার, ফ্রিতেই যদি গাভীর দুধ মেলে তাহলে কোন মূর্খ টাকা খরচা করে ঘরে গাই পোষে? ...সমরেশ মজুমদার

এমনসব লেখার প্রতিবাদ কোনো নারী করেছেন? পাল্টা লেখাও কেউ কি কিছু লিখেছেন? আমাদের জাতীয় সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজের ফাইট্টা যায়, সাবিনা ইয়াসমিনের যৌবন আমার লাল টমেটো ধরনের গানে নারীরা লজ্জা পেয়েছেন? অপমানিত হয়েছেন? বরং যেন প্রশংসা মনে করে স্বস্তিই পাচ্ছেন। শ্রদ্ধা-সম্মান পায়ে দলে কখনো আধুনিকতা, কখনো ভালোবাসা, কখনো আবেগের উসকানিতে তারা বিমোহিত।  তেল-সাবান-গহনা, টিভি সিরিয়াল, স্কুলের সামনে ভাবীদের সঙ্গে আড্ডা-আউটিং, শপিং, পারলার, জিরো ফিগার, ব্যাংস কাট আর হট পিংক লিপস্টিক, নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বামীর মানিব্যাগ নিয়ন্ত্রণ, সাধ্যে কুলালে একটা ফ্ল্যাটের দলিল হস্তগতের বাইরে কি সমৃদ্ধি এবং সুখের অন্য কোনো বিষয়-আসয় নেই?

অতএব, কাজী নজরুলের ওপর ভর করেই শেষ করছি আজকের লেখা।

জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা।

জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত-টিকা।।

দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,

নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা,

জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী,

বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।।

ধূ ধূ জ্বলে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,

জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নি!

পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা

জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,

মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা

চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।

লেখক : সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর