শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, অবস্থাপন্ন মুসলমানের জন্য হজ একটি অবশ্য পালনীয় ইবাদত। তাদের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ পালনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এ ইবাদতকে। ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজ পালনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরাফাতের ময়দানে হজ সমাবেশে লাখ লাখ হাজির লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হন। এ সমাবেশে দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকে নানা জাতি-বর্ণ-ভাষী মুসলমান সমবেত হয়েছেন মহান আল্লাহর কাছে সমর্পিত হতে। হজ পালনের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসীদের আনুগত্য যেমন প্রকাশ পায় তেমনি দেহ ও মনকে আল্লাহমুখী করা সম্ভব হয়। এ ইবাদতের মাধ্যমে মুমিনরা আত্মশুদ্ধির সুযোগ পান। হজব্রত পালনের মাধ্যমে বান্দা অতীতের ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করে নিষ্পাপ হওয়ার সুযোগ পায়। হজের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধের ভাবনা বিকশিত হয়। নানা ভাষা বর্ণ জাতির লাখ লাখ মানুষ একই ধরনের পোশাক পরে আল্লাহর কাছে নিজেদের সমর্পিত করে। হজ উপলক্ষে মানব জাতির যে মহামিলন ঘটে তা বিশ্বজুড়ে সৌহার্দের পরিবেশ গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা জোগায়। বিশ্বশান্তি ও পারস্পরিক সহমর্মিতার শিক্ষা দেয় এ ইবাদত।
কোরবানি ইসলামি শরিয়তের মর্যাদাপূর্ণ এক ইবাদত। আদিপিতা হজরত আদম (আ.)-এর আমল থেকে কোরবানি প্রথার শুরু। তবে এ প্রথা মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-এর মহান আত্মবিসর্জনের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে। কোরবানি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। হানাফি মাজহাব মতে, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে কোরবানি প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য ওয়াজিব বা আবশ্যক। শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি মাজহাব মতে, কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। বিনা ওজরে ছেড়ে দেওয়া মাকরুহ।
ইবরাহিম (আ.)-কে পবিত্র কোরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (হজ ৭৮)। ঈদুল আজহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি বিশ্বাসীদের আদিপিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন। কোরবানি হলো মহান আল্লাহর কাছে নিজেকে উৎসর্গিত করার মাধ্যম। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। যার করুণা লাভের ওপর বান্দার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে। আমাদের সবকিছু তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। কোরবানি হচ্ছে সেই নিবেদিত মনোভাবের প্রতীক।
মানুষ কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। আল্লাহর জন্য মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতেও রাজি আছে কি না সেটাই পরীক্ষার বিষয়। কোরবানি আমাদের সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদের এখন আর পুত্র কোরবানি দেওয়ার মতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। কোরবানি আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগের একটি অনুপম দৃষ্টান্ত। সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় মানুষ নিবেদিত থাকবে আল্লাহ এমনটিই চান। আল্লাহ চান বান্দার মধ্যে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠুক। কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ, ত্যাগের মনোভাবে কোরবানি সার্থক হয়। পবিত্র কোরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের উপার্জিত হালাল মালের কিছু অংশ এবং আমি যা তোমাদের জন্য জমিন থেকে বের করেছি তার অংশ ব্যয় করো।’ (বাকারা-২৬৭)। আর তাই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। কেয়ামতের দিন কোরবানির পশুর শিং, লোম আর ক্ষুর হাজির করা হবে। এগুলো সেদিন বান্দার আল্লাহ প্রেমের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে। কোরবানির রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কোরবানিদাতাদের সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত, গোশত কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে কেবল তোমাদের তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।’ (হজ ৩৭)। ঈদের দিনে গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন গোসল করতেন।’ (নাসবুর রায়াহ)। ঈদের দিন উত্তম ও সুন্দর পোশাক পরাও সুন্নত।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক