নির্বাচন পদ্ধতি, ভোটের তারিখ এসব নিয়ে সারা দেশে আলোচনার ঝড়। নানা ইস্যুর মধ্যে নীরবে মরণ কামড় বসাচ্ছে ডেঙ্গু। চলতি বছরে ডেঙ্গুজ¦রে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৯ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। জ্বর আসলেই দুশ্চিন্তা বাড়ছে মানুষের। রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের অলিগলিতে ডেঙ্গু হানা দিলেও নজর নেই কর্তৃপক্ষের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি কোনো একক কারণের ফল নয়। বিশ্বায়ন, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা ঘনত্ব এই বিস্তারে প্রভাব ফেলেছে। দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার এখন শুধু প্রাকৃতিক ঋতু পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে না। মশার জীবনচক্র তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর যেমন নির্ভরশীল, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ভেক্টরগুলোর প্রজনন মৌসুমও প্রসারিত হয়েছে। হালকা বৃষ্টিপাত মশার প্রজনন স্থলগুলো পুনরায় সক্রিয় করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশার আয়ু ও বিস্তার বাড়িয়ে দেয়।
এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আবহাওয়াভিত্তিক পূর্বাভাস মডেল গড়ে তোলা আবশ্যক। দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্ট রেয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে কাজ করছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এডিস মশার ঘনত্ব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মশার ঘনত্ব পরিমাপের একটি মাপকাঠি হচ্ছে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’। কোনো এলাকায় এই ইনডেক্স যদি ২০ বা তার বেশি হয়, সেটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বর্তমানে ঢাকার অনেক এলাকাতেই এই ইনডেক্স ২০-এর ওপরে এবং কিছু এলাকায় তা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, খুলনা, বরগুনা, পিরোজপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও চাঁদপুরে এডিস মশার ঘনত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, শুধু জুন মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯৫১ জন, মারা গেছেন ১৯ জন। জুলাইতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার ২০ জন, মারা গেছেন ৩৭ জন। এ বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ৭৯ জন। রাজধানীর হাসপাতাল, ক্লিনিক থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের চেম্বারে ডেঙ্গু রোগীদের ভিড়।
সরেজমিনে রাজধানীর মহাখালী ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সি রোগীর ভিড় হাসপাতালে। ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ কেউ রেহায় পায়নি ডেঙ্গুর কবল থেকে। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় বসেছিল মানিকগঞ্জের সাদিয়া খাতুন (১৯)। ছয়টি পরীক্ষা দেওয়ার পরে ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত হয় সে। সাদিয়া জানান, ‘মানিকগঞ্জের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন অবস্থার অবনতি হলে মহাখালী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডেঙ্গুর কারণে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমার জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে গেল, পরিশ্রম বৃথা গেল।’
নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া থেকে এই হাসপাতালে এসেছেন সোনিয়া বেগম (৩২)। সোনিয়ার ভাই জানান, প্লাটিলেট কমে ৪০ হাজারে নেমে এসেছে। জ¦র, বমি কিছুতেই কমছে না। নারায়ণগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে দেখিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা করছিলাম। অসুস্থতা বাড়লে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাড্ডা থেকে আড়াই বছরের ছেলে ওমর হাওলাদারকে নিয়ে ভর্তি হয়েছেন রীতা ইয়াসমিন। রীতা বলেন, ছেলের জ¦রের তীব্রতা দেখে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে ডেঙ্গু টেস্ট করতে বলেন। টেস্টে দেখা যায় ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে। বাড়িতে রেখে চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছিল না। এজন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।’
জ¦র আসলে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, ‘এখন ঘরে ঘরে জ¦র হচ্ছে। হাসপাতালেও রোগীর ভীষণ চাপ। জ¦রের সঙ্গে শরীরে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, গায়ে র্যাশ ওঠা বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। তাই জ¦র আসলে প্রথমে ডেঙ্গু কি না তা শনাক্তে টেস্ট করতে হবে। জ¦র কমাতে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দিতে এবং বেশি তরল পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। বোতলজাত কৃত্রিম জুস না খেয়ে টাটকা ফলের রস, স্যুপ, পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।’