গেল বছর ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে যথাক্রমে ৮ হাজার ৫৪৩ জন আর আহত হয়েছে ১২ হাজার ৬০৮ জন। গত জুন মাসে সারা দেশে ৬৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬৯৬ জন নিহত ও ১৮৬৭ জন আহত হয়েছে। পরিবহনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন না আসায় কমেনি সড়ক দুর্ঘটনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বে রোডক্র্যাশে (সড়ক দুর্ঘটনা) ১১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ নিহত হয়। বিশ্বে রোডক্র্যাশে মৃত্যুর ৯২ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে এবং মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে পথচারী, সাইকেল ও মোটরসাইকেল আরোহী। ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংকিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ ব্যতীত দেশে রোডক্র্যাশ কমানো বা রোধ করা সম্ভব নয়। সঠিক আইন ও তার প্রয়োগের ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, যা বর্তমানে একটি বড় সমস্যা, তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে। তাই সবার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, পথচারীদের অসচেতনতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার, ভঙ্গুর সড়ক, ওভারক্রসিং, অতিরিক্ত গতি, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, বিপজ্জনক ট্রাক, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালক এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানো। বর্তমানে দেশের সব সড়ক-মহাসড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির নৈরাজ্য। এসব যানবাহন প্রায় প্রতিনিয়ত মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। অসংখ্য কর্মজীবী মানুষ নিহত এবং চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিবারগুলো উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে নিঃস্ব ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে হাজার হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন ও ব্যাটারিচালিত রিকশা বহু বছর ধরেই চলছে। প্রত্যেক শহর চলমান জঞ্জাল শহরে পরিণত হয়েছে। এসব যানবাহন যেমন পরিবেশ দূষণ করছে, তেমনি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাজধানীতে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা ও মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনের দৌরাত্ম্য চলছে। এগুলো প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণে স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চলাচল করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই ১৪ লাখ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এমন এক পরিস্থিতিতে দুই সিটি করপোরেশন বুয়েটের ডিজাইন করা পাঁচ হাজার সিএনজি অটোরিকশা ও এক লাখ ই-রিকশা আগামী মাস থেকে সড়কে নামানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এতে রাজধানীর সড়কের কী ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। তীব্র যানজট ও দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের চলাচল রাজধানীর চলাচল ব্যবস্থাকে অচল করে দেবে।
বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬৪৩টি বাণিজ্যিক পরিবহন রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ হাজার ১৯৮টি বাস ও মিনিবাস, ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৫টি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ও ট্যাংকার। এগুলোর মধ্যে ৩৯ হাজার ১৬৯টি বাস, ৪১ হাজার ১৪০টি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে এবং দেশে সুষ্ঠু ও উপযুক্ত পরিবহনব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। মানুষের নিরবচ্ছিন্ন ও মসৃণ যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনের জন্য এর বিকল্প নেই। এজন্য এটা কাম্য নয়, যানজট, দুর্ঘটনা সৃষ্টিকারী হাজার হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক ও অবৈধ লাখ লাখ রিকশা অবাধে চলতে দিতে হবে। প্রশ্ন ওঠে, পরিবহন খাতে এমন নৈরাজ্য কি দশকের পর দশক ধরে চলবে? পরিবহন খাত কি বিশৃঙ্খলই থেকে যাবে? ছোট ছোট যাত্রীবাহী পরিবহন কমিয়ে কীভাবে গণপরিবহন বাড়ানো যায়, এ পরিকল্পনা করতে হবে। বিআরটিসিসহ পরিবহন মালিকদের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ, যানজট সৃষ্টি, দুর্ঘটনাপ্রবণ ও পরিবেশদূষণকারী যানবাহনকে আর কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়ক-মহাসড়ক থেকে তুলে দিতে হবে।
কথা ছিল ১ জুলাই থেকে রাজধানীতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং আগের মতোই দাপিয়ে চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এখনো লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনের দখলে রাজধানীর সড়ক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাস সময় বেঁধে দিলেও আসেনি ইতিবাচক পরিবর্তন।
সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের মাথা ঠান্ডা রেখে চালাতে হয় গাড়ি। অল্প দক্ষ বা অদক্ষ চালক দিয়ে কখনোই গাড়ি চালানো ঠিক নয়। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের কারণে। তাই এ ক্ষেত্রে গাড়ির মালিকদের সচেতন হতে হবে। কারণ আপনার সচেতনতাই রক্ষা করতে পারে হাজারো মানুষের জীবন। অনেকে মানছে না ট্রাফিক আইন। হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণ হারাচ্ছেন চালক ও আরোহী। তাই একটুখানি সচেতনতাই পারে আপনাকে দুর্ঘটনা এবং আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে। অনেকে আবার ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে চেষ্টা করেন। যার ফল হয় ভয়াবহ। প্রাণহানি ঠেকাতে সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে। মনে রাখবেন একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ