আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশে দেখেছি শুধু স্বৈরাচার পালিয়েই শুধু যায়নি, তার ৩০০ এমপি, তার মন্ত্রিসভা, পুলিশ বাহিনী, দলীয় নেতা-কর্মী এমনকি মসজিদের ইমাম এবং নিজেদেরকে শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ বলে দাবি করা উচ্চ আদালতের বিচারকরাও পালিয়েছেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এ গতকাল সূচনা বক্তব্যে এসব কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর। সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে এই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। আজ এই মামলায় প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হবে।
সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে তার বিচার শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হবে। এ ধরনের অপরাধের বিচার কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালত বা দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আদালতেও সম্ভব নয় বলে গণমাধ্যমকর্মীদের গতকাল জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে আহত ও হত্যার পর জীবিত ও মৃতদের লাশ পুলিশের ভ্যানে পোড়ানো হয়েছিল শুধু আলামত ধ্বংস বা অন্যদের ওপর দায় চাপানোর উদ্দেশ্যে। তদন্তে পাওয়া গেছে, আগুনের তীব্রতা আরও বাড়ানোর জন্য জ্বলন্ত লাশের ওপর আসামিরা শুকনো কাঠের টুকরো নিক্ষেপ করে। একজন আসামি তার হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট ওই আগুনে নিক্ষেপ করে। মানবতা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একজন মানুষ ছয়জন মানুষের ওপর জ্বলন্ত আগুনে সিগারেট বা শুকনা কাঠের জ্বালানি নিক্ষেপ করতে পারে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, বিশ্বের দেশে দেশে ফ্যাসিস্টদের জন্ম হয়েছে। এডলফ হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, পিনোশে, মার্কোসের নাম শুনেছি। এসব ফ্যাসিস্ট এবং স্বৈরশাসকদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। এই ফ্যাসিস্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। আমরা তার দোসরদের বিরুদ্ধেই এই ট্রাইব্যুনালের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। এই মামলায় মোট আসামি ১৬ জন। তাদের মধ্যে ৮ আসামি গ্রেপ্তার আছেন। গ্রেপ্তাররা হলেন- সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক ও সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচারও করা যাবে ট্রাইব্যুনালে : এদিন ট্রাইব্যুনাল চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান, ডিফেন্সের (সশস্ত্র বাহিনী) উচ্চ পদে যাঁরা রয়েছেন, তাদের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে হবে, নাকি অন্য কোনো আদালতে হবে? জবাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর বিভিন্ন ধারা-উপধারা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এই বিতর্ক অহেতুক, অপ্রাসঙ্গিক। মূলত আইনটি তৈরিই করা হয়েছিল এ অপরাধে যুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার করার জন্য। এর মধ্যে আইনটি সংশোধন করে আরও কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে।’ পরে ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তাজুল ইসলাম বলেন, এই আইন এতটাই স্পষ্ট যে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এই আইন আর্মড ও অক্সিলিয়ারি ফোর্সের (সশস্ত্র ও সহযোগী বাহিনীর) বিচারের জন্য।
আমার রাইফেল কেড়ে নিয়ে সুজনকে দেন এডিসি স্যার : ‘এডিসি আখতার (রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম) স্যার আমাদের সবাইকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। আমি গুলি করতে চাইনি। এ সময় আখতার স্যার আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে আমার হাতে থাকা চায়নিজ রাইফেল ও ৪০ রাউন্ড গুলি কেড়ে নিয়ে কনস্টেবল সুজনের হাতে দেন। কনস্টেবল সুজন, ইমাজ, নাসিরুল ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে গুলি করতে দেখি।’
পাশে থাকা আন্দোলনকারীর বুকের বাম পাশে গুলি লাগে : শিক্ষার্থী সৌরভ আহমেদ তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘৫ আগস্ট সকালে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে আমার রায়সাহেব বাজারের মেস থেকে বের হয়ে চানখাঁরপুল এলাকায় যাই। আমরা বহুসংখ্যক আন্দোলনকারী শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার সময় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে পৌঁছালে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নিই। পুলিশের তীব্র গুলির মুখে আমিসহ আরও অনেকে ১নং নবাবকাটারা রোডে আশ্রয় নিই। সেখানে পুলিশের গুলিতে অনেক আন্দোলনকারী আহত হয়।’
আমার হাত থেকে চায়নিজ রাইফেল কেড়ে নেন এডিসি আখতারুল স্যার : ২০২৩ সালে কনস্টেবল পদে পুলিশে যোগদান করা অজয় ঘোষ গত বছর ৫ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে অজয় ঘোষ জানান, ১৩ এপিবিএন উত্তরা থেকে শাহবাগ থানায় আনা হয়েছিল তাদের।
এডিসি আখতারুলের নির্দেশে শহীদ মিনারে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলি করে আন্দোলনরত ব্যক্তিদের ছত্রভঙ্গ করা হয় জানিয়ে জবানবন্দিতে অজয় ঘোষ বলেন, ‘আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে আমরা চানখাঁরপুল চৌরাস্তার মোড়ে অবস্থান নেই। তখন অলিগলিতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ভিড় ছিল। তারা শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।’ তিনি বলেন, ‘এডিসি আখতার স্যার আমাদের সবাইকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেয়। আমি গুলি করতে চাইনি। আক্তার স্যার আমাকে ... বলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আরও বলেন, সরকারি বেতন-রেশন খাস না, গুলি করবি না কেন? পরে এডিসি আখতার স্যার আমার হাতে থাকা চায়নিজ রাইফেল ও ৪০ রাউন্ড গুলি কেড়ে নিয়ে কনস্টেবল সুজনের হাতে দেয়। সুজনের হাতে থাকা ঢাল লাঠি আমার হাতে দেয়। কনস্টেবল সুজন, ইমাজ, নাসিরুল মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, নাজিমুদ্দিন রোড, নবাবকাটারা, বকশীবাজার মোড়ে অবস্থানরত ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে তাদের গুলি করতে দেখি। পরে জানতে পারি সেখানে ছয় থেকে সাতজন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।’
ডিএমপি কমিশনার হাবিব গুলির নির্দেশ দেন : ১৩ এপিবিএনের নায়েক আবদুর রহমানও গত বছর ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট ভোর ৫টার দিকে ২০ জনের দল নিয়ে শাহবাগ থানায় রিপোর্ট করলে অফিসার ইন চার্জ আমাদের জানান, ডিএমপির পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী আন্দোলনকারীদের ওপর সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ ও গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন।