জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদকে শক্তিশালী আইনি ভিত্তি দিতে ও পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এফিডেভিট অথবা শপথবাক্য পাঠ করতে হবে। যেসব দল এটা করবে না তারা পরবর্তী নির্বাচনে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
দলটির এ ধরনের প্রস্তাবে নয়া বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, আলোচনার শেষ মুহূর্তে এসে জামায়াতের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হবে বলে জানি। সেখানে সবার মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে এটা এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এ ধরনের প্রস্তাব নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, এটার ওপর আলোচনা শেষ হয়নি। তাই সিদ্ধান্তও হয়নি।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছি। এই পথেই যাব। আমাদের যাত্রাপথ পরিষ্কার। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটাই পথ। জুলাই সনদে একমত হয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা নির্বাচন পর্যন্ত যেতে চাই। ভিতরে কোনো দুশ্চিন্তা রেখে যেন আমাদের নির্বাচনে যেতে না হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা শুধু নির্বাচন না, এটা নবজাগরণ। এই যে এত ত্যাগ, আত্মাহুতি- এগুলো সার্থক হবে যদি আমরা ওই নবজন্মটা লাভ করতে পারি। নতুন বাংলাদেশ গড়তে, নিজেদের সব চাওয়াপাওয়া পূরণ করতে যে সুযোগ এসেছে, তা আর আসবে না। এই সুযোগ হারানো যাবে না। ছোটখাটো বিষয়ে আটকে গিয়ে আমরা যেন বড় জিনিস হারিয়ে না ফেলি। আমরা এমনভাবে এই জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিতে চাই যে এটা শুধু ওপরের দিকে উঠবে; ডানে-বাঁয়ে তাকানোর দরকার হবে না। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা এগিয়ে নেওয়ায় সব রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আলোচনা চলবে। এই আনন্দঘন পরিবেশ বজায় রেখেই আমরা নির্বাচন পর্যন্ত যেতে চাই। উৎসব এখান থেকে সৃষ্টি হবে। সেই উৎসব নিয়েই নির্বাচন হবে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হবে। এখন থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কাজটা (জুলাই সনদ) যদি আমরা করে ফেলতে পারি, তাহলে আমাদের দেশ যেমন নিশ্চিন্ত হবে, তেমনি সারা পৃথিবী আমাদের অনুসরণ করবে। এখনো আমরা সবাই বুঝছি না যে ঐকমত্য কমিশন আমাদের কী দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ উদ্বোধনের পর এটাই তার কমিশনের বৈঠকে প্রথম উপস্থিতি। সংলাপে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হলেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। সংলাপে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আবারও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে বলে বৈঠকে মন্তব্য করেন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গতকালের বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জামায়াত বলেছে অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ, আর বিএনপির পক্ষ থেকে অতিরিক্ত বা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের জন্য সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। এ ছাড়া গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান ও নতুনভাবে লিখিত ধারা-উপধারা ও অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সংশোধনী ও সংস্কার করা সম্ভব বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তারা এসব প্রস্তাব দেন।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন কোনোভাবেই একটা আরেকটি ওপর সম্পর্কিত নয়। সংস্কার সংস্কারের মতো চলবে, এটা কন্টিনিউ প্রসেস। বিচারেও টাইম লিমিট করা যায় না, তাতে অবিচার হবে। সেটা চলবে, যে সরকারই আসুক। কিন্তু নির্বাচনকে এটা কন্ডিশনাল করা যাবে না। নির্ধারিত টাইমলাইনে নির্বাচন হতেই হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে রিজিওনাল সিকিউরিটির জন্য থ্রেট হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাংবিধানিক ১৯টি বিষয়ের কথা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ আমরা একমত হয়েছি। আমাদের বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের ৪টি বিষয়ে এমপিদের স্বাধীনতা না থাকলে ভালো হয়। সর্বনিম্ন দুটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টের ভাষা উল্লেখ করে সনদ তৈরি হচ্ছে এবং সেভাবে আমরা স্বাক্ষর করব। যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবে। এটি কোনো জটিল বিষয় নয়। দুই-তিনটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বাকিগুলো খুবই সাধারণ বিষয় উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ। কিন্তু ফোরাম কোনটা। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কি না, এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে জানান, আমরা একমত। আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি, তা আগেও বলেছি।
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হলেই তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। দলের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নের দুটি উপায়ের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি হলো প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার। অতীতে এটার নজির আছে। আরেকটি হলো গণভোট। এটার ইতিহাসও দেশে আছে। দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে মানুষ রায় দেবে। এনসিপি সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, এনসিপি মনে করে, একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান ও নতুনভাবে লিখিত ধারা-উপধারা ও অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে সংশোধনী ও সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছি, সেগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, চব্বিশের জুলাইতে ছাত্র-জনতা রক্ত ও জীবন দিয়েছে দেশ থেকে স্বৈরতন্ত্রকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য। হাসিনার পলায়ন সেই চাওয়ার একটা অংশ। পরের কাজ ছিল, সংবিধান, আইন ও রাজনৈতিক সংস্কার করে দেশে স্বৈরাচার সৃষ্টির সম্ভাব্য সব পথ রুদ্ধ করা।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক : জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গতকাল সকালে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করে। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।