বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ যখন নিষ্ঠুর ও নির্মম কায়দায় নিরীহ নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সামরিক বাহিনী নামানো হলো শেখ হাসিনার নির্দেশে; দেশের সর্বত্র তখন চলছে লীগ ও নামধারীদের নির্মমতা, ঠিক সে সময়ে সামরিক বাহিনীর অকুতোভয় নির্ভীক দেশপ্রেমিক অবসরপ্রাপ্ত কিছু অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে যে ঘোষণাটি আমরা পাঠ করি, তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। সামরিক বাহিনী ঘুরে দাঁড়াল মাফিয়া শাসনের বিরুদ্ধে। সেই ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ-
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের আহ্বান-দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আমরা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যরা গভীরভাবে মর্মাহত ও হতাশ। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটানীতি বাতিলের ন্যায্য দাবি নিয়ে গত ১ জুলাই থেকে কোমলমতি, নিরীহ, নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করলে দেশের অসংখ্য মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ করছি, সরকার তাদের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা না করে এ আন্দোলন প্রতিহত করতে হিংস্র রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়। প্রথমে ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীকে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর লেলিয়ে দেন। তাদের বর্বরোচিত আক্রমণে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারীকে গুরুতর আহত ও গুম করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতিহত করতে বর্বর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত বিজিবি, র্যাব, আনসার ও পুলিশের নির্বিচার আক্রমণ; ব্যবহার করা হয় হেলিকপ্টার ও স্নাইপার, যা যুদ্ধক্ষেত্রেও সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। এ আক্রমণ এতটাই বর্বর ও নৃশংস ছিল যে, হত্যার শিকার প্রতিটি মানুষের শরীর বুলেটে ঝাঁজরা এবং অন্ধ হয়ে যায় অনেকে। এমনকি আক্রমণকারীরা হাসপাতালে গিয়েও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায় এবং চিকিৎসাবঞ্চিত করে, যা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না।
নির্লজ্জতা ও নির্মমতার এখানেই শেষ নয়; আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার কারফিউ জারি করে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নামায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে। লক্ষ করলাম, জাতিসংঘ মিশনে ব্যবহৃত এপিসি ও অন্যান্য অস্ত্র-সরঞ্জামাদিও ব্যবহার করা হয় শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বিরুদ্ধে। অতি উৎসাহী কিছু অফিসার বিবেক বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনরত মানুষের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করেন, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত গৌরব ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় এর মাধ্যমে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের গৌরব আমাদের এ প্রাণের সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বর্তমান প্রজন্ম আমাদের অনুজ, আমাদের ছোট ভাইবোন ও সন্তান। তারা ইউনিফর্ম পরিধান করে বিধায় অনেক কিছুই খোলাখুলি বলতে পারে না। তাই অগ্রজ হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা। সুতরাং আমরা জনগণের বিরুদ্ধে এসব হীন কাজ থেকে সামরিক বাহিনীকে বিরত রাখতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই। এত অল্প সময়ে নিজ দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিশাল এ হতাহতের নজির বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে এ দেশে তো বটেই, বিশ্বের কোথাও মিলবে না। এমন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা বা ধিক্কার ও প্রতিবাদের উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। বিপুল এ প্রাণহানির দায় অবশ্যই সরকারের। সাংবিধানিক শপথ ও আইন উপেক্ষা করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রকাশ্যে চরম উসকানিমূলক দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর তাদের লালিত গুন্ডা বাহিনীকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিলেন। এতে সমগ্র জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হতবাক, স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ, ব্যথিত এবং গভীরভাবে মর্মাহত। রাষ্ট্র যখন আক্রমণকারী হয়, জনগণ বিচার চাইবে কার কাছে।
আমরা মনে করি, সংবিধান অনুযায়ী বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় কঠোর অবস্থান নিতে হয়। কিন্তু তা কোনোক্রমেই দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী হওয়া কাম্য নয় এবং যতক্ষণ সে দায়িত্ব জনবিরোধী পর্যায়ে না পড়ে শুধু ততক্ষণ সে দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। কিন্তু জনবিরোধী হওয়ার উপক্রম হলেই তা থেকে বিরত হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। এ বাহিনীর সব সদস্য এ দেশের সাধারণ জনগণেরই অংশ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ তথা দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ সেই নিরিখে অবৈধ ও জনবিরোধী। এমনকি যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে, সে সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি ও একই সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ। বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি, অবিলম্বে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে এই নিষ্ঠুর অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সব অফিসার ও সৈনিককে উপরোল্লিখিত কার্যকলাপ থেকে বিরত থেকে সংবিধানের মূল দাবি অনুযায়ী জনগণের পাশে থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন।