অভাবিত কিছু না ঘটলে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। লন্ডন বৈঠকের পর সরকার নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টির অপকৌশল থেকে আপাতত সরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। এ ঐকমত্যের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু শুধু নয়, প্রকারান্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ত্যাগেরও সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এটি সরকারের জন্যও একটি ইতিবাচক দিক। তবে ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচন ভণ্ডুলের জন্য সরকারের ভিতর থেকে নানামুখী অপতৎপরতা চলছে এমন অভিযোগও সাধারণ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো সুযোগ নেই। তারপরও বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় যেহেতু গঠিত, সেহেতু তারা সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা এ সরকারের প্রধান কর্তব্য। অথচ তারা সে কর্তব্যের প্রতি কতটা মনোযোগী তা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে নির্বোধ ভেবে স্থানীয় সরকার সংস্কারের নামে পাকিস্তান আমলের ঘৃণিত মৌলিক গণতন্ত্রের প্রেতাত্মা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সভ্য সব গণতান্ত্রিক দেশে স্থানীয় সরকারকে জনগণের সরকার বলে ভাবা হয়। কারণ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভার মতো স্থানীয় পর্যায়ের ‘সরকারের’ সঙ্গে থাকে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সুখ-দুঃখের সম্পর্ক। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কোনোভাবেই সে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
পাকিস্তানের সেনাপতি শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের কথা এ যুগের প্রবীণদের অনেকেরই জানা। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করেন এই জেনারেল। বাড়ির নিরাপত্তার জন্য যে দারোয়ান পোষা হয়, সে হয়ে দাঁড়ায় বাড়ির মালিক। অবৈধ দখলদারি চিরস্থায়ী করতে মৌলিক গণতন্ত্র নামের এক অদ্ভুত গণতন্ত্র হাজির করেন তিনি।
মৌলিক গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট, সবকিছু নির্বাচনের ভার দেওয়া হয় ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর হাতে। মৌলিক গণতন্ত্রী বা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচন ছাড়া আর কোথাও জনগণের ভোটাধিকার ছিল না। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। তার মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থারও ইতি ঘটে। অনেকের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার কবর থেকে মৌলিক গণতন্ত্রের পচা লাশ উঠিয়ে তা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কারও কারও মতে, এটা চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না জেনেও বিষয়টির অবতারণা করা হচ্ছে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির জন্য।
জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রতিষ্ঠা হলেও সেখানেও চলছে মাদারির খেল। বাংলাদেশে ইসরায়েল মার্কা আনুপাতিক হারের নির্বাচনব্যবস্থা চালুর জন্য অশুভ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী
একটি মহল। যে কোনো নির্বাচন হতে হবে সংবিধানের অধীনে। সংবিধান সংশোধন ছাড়া যে আনুপাতিক হারের নির্বাচন সম্ভব নয়, তা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অজানা নয়। সরকার বা নির্বাচন কমিশন চাইলেও এমন কোনো নির্বাচনি বিধান চাপিয়ে দিতে পারবে না, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় বলা হয়েছে, একক আসনভিত্তিক নির্বাচনের কথা। সে পথ এড়িয়ে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পথে হাঁটার চেষ্টা কীসের আলামত তা স্পষ্ট নয়।
সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনে একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দলের প্রার্থী থাকে। থাকতে পারে নির্দলীয় প্রার্থীও। নির্বাচনে এসব প্রার্থীর মধ্যে যিনি বেশি ভোট পান তিনিই জয়ী বলে ঘোষিত হন। প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল কোনো আসনে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিলে সত্যিকারের যোগ্য প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসার সম্ভাবনা থাকে। দেশের ইতিহাসে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসার অসংখ্য নজির রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সত্যিকারের যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করে। আনুপাতিক হারের নির্বাচনে প্রার্থীরা দলের নেতৃত্বের কাছে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়ে। যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন না পেলে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুযোগ থাকে না। আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। এর ফলে কোনো এলাকা থেকে একাধিক সংসদ সদস্যের সংসদে আসার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আবার কোনো এলাকা সংসদ সদস্যশূন্য হয়ে থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমের কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষ তার নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় একজন ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। যিনি তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাকে দেখেই ভোটাররা ভোট দেন। একাধিক প্রতিনিধি মানুষের মধ্যে ভোটের আগ্রহ কমিয়ে দেবে এবং কার্যকরী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কোনো বিধানও আনুপাতিক হার বা পিআরে নেই। একজন জনপ্রিয় নিরপেক্ষ ব্যক্তির নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। এরকম বহুবিধ অসুবিধা আছে পিআর পদ্ধতিতে। এসব কারণে কোনোমতেই তা মানা সম্ভব নয়। যে কারণে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আনুপাতিক হারের ভোটের প্রস্তাবকে আমলে নিতে রাজি নয়। বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের বৃহত্তম দলটি। আনুপাতিক হারের পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে দেশের সবচেয়ে বড় দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের জন্য এককভাবে সরকার গঠন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ওই পদ্ধতিতে তারা ৩০০ আসনের মধ্যে ১২০ আসন পাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ২১টি আসনের জন্য তাদের অন্য দলের কাছে হাত পাততে হবে। নইলে তারা সরকার গঠন করতে পারবে না। এরকম জটিল অবস্থায় কোয়ালিশন সরকার গঠন এবং ঝুলন্ত সংসদ অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। এতে কোনো সরকারের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা সম্ভব হবে না। বিদেশিরা দেশের ব্যাপারে নাক গলানোর সুযোগ পাবে।
আনুপাতিক হারের নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপদ ডেকে আনে এটি একটি প্রমাণিত সত্য। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ নেপাল। নেপালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পর গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বেছে নেওয়া হয় আনুপাতিক হারের নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্বাসনে চলে গেছে। কোনো সরকারের পক্ষে এক বছরও ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্টের জন্য আনুপাতিক হারের নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে বিদেশি মদতপুষ্ট অশুভ কোনো মহল।
সবচেয়ে বড় কথা আনুপাতিক নির্বাচন চালু করতে চাইলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। সংবিধান সংশোধন করা যায় জাতীয় সংসদে। দেশে বর্তমানে কোনো জাতীয় সংসদ নেই। ঐকমত্যের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারের নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হলে তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কারণ সরকারের গঠিত ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনা করছে তাতে সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বা তারা অংশ নিচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য একের পর এক অদ্ভুত প্রস্তাব আনা হচ্ছে। আনুপাতিক হারের নির্বাচন তার মধ্যে একটি। এটি কোনোভাবে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কেড়ে নেওয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জন্য এ দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় বিশেষ একটি দেশ। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ দলগুলোকে তারা তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথে বাধা মনে করে। বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে তারা পথের কাঁটা বলে মনে করে। আর সে কারণেই বিদেশি অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে পক্ষে এনে আনুপাতিক হারের নির্বাচনের মতো বিতর্কিত ব্যবস্থা চালু করতে চাচ্ছে। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেস্তে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি। এমনটি হলে বাংলাদেশের ওপর যা ইচ্ছা তাই চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। দেশবাসীকে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে জোরালোভাবে। বাংলাদেশকে গাজা বানানোর জন্য যারা ইসরায়েলি পদ্ধতির নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চায় তাদের রুখতে হবে যে কোনো মূল্যে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব
ডাকসুর সাবেক জিএস