মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তৈরি পোশাক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা তাদের জানিয়ে দিয়েছেন, পাল্টা শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও তাদের কাছে শুল্ক আরও কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে শুল্ক কমানোর আলোচনার বাইরে মার্কিন প্রতিনিধিরা আগ্রহ দেখিয়েছেন বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে। আজ আরও কয়েকটি বৈঠকের পর সফর শেষে ঢাকা ছাড়বেন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদলটি।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) ব্রেন্ডন লিঞ্চের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি গতকাল সকালে মার্কিন দূতাবাসের চিফ অব মিশনের বাসভবনে বৈঠক করে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ব্রেন্ডন লিঞ্চে ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ইউএসটিআরের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক এমিলি অ্যাসবি, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, লেবার অ্যাটাশে লীনা খান। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের নেতৃত্বে বিজিএমইএ প্রতিনিধিদলে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি রেজওয়ান সেলিম, পরিচালক ফয়সাল সামাদ, পরিচালক আবদুস সালাম এবং বিজিএমইএ স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এফটিএ অ্যান্ড পিটিএ এর চেয়ারম্যান লুৎফে এম আইয়ুব। বৈঠকের পর বিজেএমইএ জানায়, বৈঠকে মূলত বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক হার কমানোর বিষয়টি এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির ওপর গড় এমএফএন শুল্ক ১৬.৫% এবং এর সঙ্গে ২০% পাল্টা শুল্ক মিলিয়ে মোট শুল্কের পরিমাণ প্রায় ৩৬.৫%, যা বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ‘স্ট্যাকিং মেথড’ ব্যবহার করে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে এই শুল্কের সমন্বয় করা যেতে পারে।
আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্বাহী আদেশ নিয়েও কথা হয়, যার অনুসারে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পোশাকে যদি ২০% বা তার বেশি যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তবে সেই পণ্যের ওপর আরোপিত ২০% অতিরিক্ত শুল্ক থেকে আনুপাতিক হারে অব্যাহতি পাওয়া যাবে।
কোন প্রক্রিয়া বা ফর্মুলায় যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহারের মূল্যায়ন এবং ট্রেসেবিলিটি নিশ্চিত করা হবে, তা তারা জানতে চান। জবাবে মার্কিন প্রতিনিধিদল জানায়, ইউএস কাস্টমস বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এটি শেষ হবে।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদে র সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশে শ্রম আইন সংস্কার করা হবে, এটি অত্যন্ত প্রত্যাশিত। তিনি আইএলও-এর গাইডলাইন অনুসরণ করে বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এর সংশোধনী করার পরামর্শ দেন।
এদিকে গতকাল ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে প্রস্তুত। এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশি পণ্যে আরোপিত মার্কিন শুল্ক আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি জানান, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, ইউএসটিআরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক এমিলি অ্যাসবি, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মুরশেদ, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দে অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, সয়াবিনসহ কৃষিপণ্য আমদানি বাড়ানোর আগ্রহও প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া জ্বালানি খাতে সহযোগিতা জোরদার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি, বেসামরিক বিমান কেনা, মাদক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং চলমান রোহিঙ্গা মানবিক সংকট নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান আবুল কালাম আজাদ। দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততায় ধারাবাহিক অগ্রগতির ওপর গুরুত্বারোপ করে চলমান আলোচনার ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের স্বার্থের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। তাই প্রক্রিয়াটি আরও সহজ ও আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ১১ দফা ‘বাংলাদেশ লেবার অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও ন্যায্য অনুশীলন রক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তুলে ধরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ এবং স্বল্প সুদে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি প্রত্যাশা করছে। সেই সঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে বলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে ব্রেন্ডেন লিঞ্চ বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যঘাটতি একতরফাভাবে কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফলে আলোচনার প্রক্রিয়া মসৃণ হয় এবং ইতিবাচক ফল এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ : ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের সঙ্গে গতকাল তাঁর সচিবালয়ের অফিস কক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন- অ্যাসিস্ট্যান্ট ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) ব্রেন্ডন লিঞ্চ এবং ডিরেক্টর (দক্ষিণ এশিয়া) ইমিলি অ্যাসবি।
সাক্ষাৎকালে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল রূপান্তরের অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরদার করার আশা ব্যক্ত করেন। বিশেষ সহকারী বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকালে উভয়পক্ষ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক, তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি, ডেটা গভর্নেন্স, ইলেকট্রনিক আইডি অথেন্টিকেশন, ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্টাকচার, ক্লাউড সার্ভিস, ইন্টার অপারাবিলিটি, ডিজিটাল সার্ভিস ইকোসিস্টেম, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন এবং ডিজিটাল অর্থনীতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন।