ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে দখলদার ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণের কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বলেছেন, হৃদয়বিদারক এ পরিকল্পনা ভবিষ্যতে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব করে তুলবে। এর আগে তিনি বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ যখন সোচ্চার, তখন হামাস নেতারা অবস্থান করছেন এই যুক্তিতে কাতারে বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে তা নিন্দনীয়। কাতারের দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক মোহাম্মদ এলমাসরি কাতারে ইসরায়েলের হামলাকে আরবদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ইসরায়েলের হামলা থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে এমন যদি কোনো দেশ থাকত, তবে সেটি ছিল কাতার। এমনিতেই এটি একটি ছোট দেশ।
ইসরায়েলের জন্য কাতার কোনো হুমকি নয়। যুক্তরাষ্ট্রেরও মিত্র কাতার। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিটিও সেখানেই। গত মে মাসেও কাতার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। বহু সংঘাতে মধ্যস্থতা করে এই অঞ্চলে শান্তি-প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে কাতার নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। গত মাসেই গাজার যুদ্ধবিরতি আলোচনার অংশ হিসেবে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পরিচালক দোহায় কাতার সরকারের আতিথ্য পেয়েছেন। তারপরও বাস্তবতা হলো, কাতারের কখনো নিজেদের নিরাপদ মনে করা উচিত ছিল না। আরব ভূখণ্ডের অন্য কোনো দেশেরও নিরাপদ ভাবার সুযোগ নেই। কারণ ইসরায়েল এমন একটি দেশ, যে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে স্বীকৃত সম্পর্কের নিয়মে আবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক আইন অগ্রাহ্য করা তাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের দেশকে ঈশ্বরপ্রদত্ত ম্যান্ডেট দাবি করে তারা। যেখানে এর সম্প্রসারণের পথে যে কোনো মানুষ বা রাষ্ট্রকে কেবল বাধা হিসেবে দেখা হয় এবং সরিয়ে দেওয়া হয়।
ইসরায়েল শুধু আইন অমান্যকারী দস্যু রাষ্ট্র নয়; এটি এমন এক রাষ্ট্র, যা প্রকাশ্যে সব ধরনের নীতি ও প্রচলিত রীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। এর নেতারা বহুদিন ধরে এমন এক ‘বৃহৎ ইসরায়েল’-এর স্বপ্ন দেখছেন, যা ইরাকের ইউফ্রেটিস নদী থেকে মিসরের নীল নদ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি কোনো গোপন ষড়যন্ত্র নয়, আবার এ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে কোনো উচ্চস্তরের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজনও নেই। শুধু ইসরায়েলি রাজনীতির দিকে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। আগস্টে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু টেলিভিশনে আবারও এই প্রকল্পের প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল একাধিক আরবভূমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। জাতিসংঘের সর্বাধিক প্রস্তাবই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গৃহীত হয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী গাজায় একজন হামাস কমান্ডারকে লক্ষ্যবস্তু করতে গিয়ে ১০০ বেসামরিককে হত্যা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলের একটি নিধন কর্মসূচি রয়েছে, যেখানে যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং রাতের বেলায় তাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়, যাতে পরিবার-পরিজনসহ তারা ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যায়। একই ধারা দেখা যাচ্ছে পশ্চিমতীরেও।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল নজিরবিহীন হারে জমি দখল ও হত্যা চালিয়েছে। শুধু এ বছরেই এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি খুন হয়েছেন এবং হাজারেরও বেশি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্ণ আশীর্বাদে ইসরায়েল এখন আনুষ্ঠানিক দখলদারির পথে অগ্রসর হচ্ছে। ফিলিস্তিনের বাইরেও ইসরায়েল তার যুদ্ধযন্ত্র লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরান পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা লেবাননের জনবহুল এলাকাতে স্কুল ছুটির সময়ে পেজার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক দুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য করা এই হামলাকে সাবেক সিআইএ প্রধান লিওন প্যানেটা বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদ’। কাতারে এসে ইসরায়েল আরও একটি সীমারেখা অতিক্রম করেছে। দোহায় চালানো আঘাতে হামাস কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য এবং একজন কাতারি অফিসার নিহত হয়েছেন, যদিও হামাস জানিয়েছে তাদের শীর্ষ নেতারা বেঁচে গেছেন।
ইসরায়েলি আগ্রাসন ও হামলার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জননন্দিত নেতা তারেক রহমানের গভীর উদ্বেগ কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। তিনি যে শহীদ জিয়ার উত্তরসূরি এ উদ্বেগ তা স্পষ্ট করেছে। সবারই জানা, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন ছিল সত্যিকার অর্থে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মুসলিম দেশগুলোর একাংশের স্বীকৃতি পেলেও সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বেশ বেগ পেতে হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার প্রথম থেকেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বুঝতে পারেন নিজের স্বার্থেই মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য তার বিকল্প নেই।
ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি দখলদারত্ব ছিল আরব তথা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন সমস্যা। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ছিল ফিলিস্তিনি ভাইদের পক্ষে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম মুসলিম বিশ্বের সহানুভূতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। স্বভাবতই ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বাংলাদেশের জন্য ছিল নৈতিক দায়। একই সঙ্গে কৌশলগতভাবে মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জনের একটি কার্যকর উপায়। এ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের ফিলিস্তিনবান্ধব নীতি ছিল সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক বিচক্ষণতার স্বাক্ষর।
এ কারণে তিনি শুধু ফিলিস্তিন নয় আরব বিশ্ব তথা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা বলে বিবেচিত হতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জিয়াউর রহমান ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দৃঢ়ভাবে সমর্থন করাকে কর্তব্য বলে ভাবেন। তিনি ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পিএলওকে ফিলিস্তিনিদের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন। এই পদক্ষেপ ছিল সে সময়ে অবশ্যই একটি সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব ছিল ইসরায়েলের পক্ষে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতিতে পিএলওর অবস্থান নিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যেও মতভেদ ছিল। এসব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের আমলেই বাংলাদেশে পিএলওর দূতাবাস স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। ফিলিস্তিন তথা মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের প্রতি শহীদ জিয়ার আন্তরিক সামর্থনের এটি একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত। পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেক দেশের কাছে তখনও পিএলওকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক জিয়া এর বিপরীতে যাওয়ার সাহস দেখান ও ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ফিলিস্তিনের পক্ষে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। ফিলিস্তিন ইসরায়েলি। সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি দৃঢ়ভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে ধরেন। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ওআইসির একটি সক্রিয় সদস্যে পরিণত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। এটি ছিল মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশের একটি বলিষ্ঠ অঙ্গীকার। সে অঙ্গীকারে আবদ্ধ আজও বাংলাদেশের মানুষ। তারেক রহমানের উদ্বেগে তার প্রকাশ ঘটেছে। ইসরায়েলকে থামাতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বিশ্ববাসীকে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, ডাকসুর সাবেক জিএস ও সংসদ সদস্য