আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে নয়া সমীকরণের প্রস্তুতি চলছে। নতুন মেরূকরণের পথে হাঁটছে দেশের রাজনীতি। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় এখন দৃশ্যপটে নেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি এখনো দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জায়গায় থাকলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে একসময়ের চারদলীয় জোট সরকারের অংশীদার ও মিত্রদল জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনি জোট গঠন, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা কৌশল গ্রহণের পরিকল্পনাকে বুদ্ধিবৃত্তির খেলা বলে মনে করছে দলটি। বিপরীতে জামায়াতের এই চ্যালেঞ্জকে সাদরে গ্রহণ করছে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। তারাও তাদের নির্বাচনি কৌশল হাতে নিচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে তিন মাসব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা থাকলেও সেটিকে পরিবর্তন করে সারা দেশে আরও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর এ ব্যাপারে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার সতর্ক করে যাচ্ছেন দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের। তিনি বলছেন, আগামী নির্বাচন হবে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন। এ নির্বাচনে জিততে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে, জনগণের কাছে থাকতে হবে এবং জনগণকে সঙ্গে রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে পরিকল্পিতভাবে জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বিএনপিকে ঠেকাতে ইসলামী আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ও খেলাফত মজলিশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদকে নিয়ে জোট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নির্বাচনের আগে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও তৎপরতা জানান দিতে এবার রাজপথে নামছে জামায়াত জোট। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি এবং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি সামনে রেখে মাঠে নামার ঘোষণা তাদের। এভাবেই বিএনপিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে জামায়াত। এনসিপি ও এবি পার্টি অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিম্নকক্ষের নির্বাচনে পিআর দাবি থেকে কিছুটা পিছুটান দিলেও ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অবিশ্বাস্য বিজয়ে জামায়াতের মনোবল এখন আকাশচুম্বী। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে তারা অ্যাসিড টেস্ট হিসেবে নিয়ে আশাতীত সফল হয়েছে বলে মনে করছে। একই ধারাবাহিকতায় জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াত মিরাকল ফলাফল করবে বলে আশা করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী মহলের অনেকে।
অন্যদিকে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নতুন কোনো নির্বাচনি জোটের ঘোষণা এখন পর্যন্ত না দিলেও স্বৈরাচার হাসিনা সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ও সমমনা দলগুলোকে নিয়েই তৎপর রয়েছে। এদের সঙ্গে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। এমনকি আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর ছাড়া আরও কোনো সমমনা দল, জোট কিংবা ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিকে স্বাগত জানাবে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরও আগে থেকেই আগামী সংসদ নির্বাচন এবং নির্বোচনোত্তর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এ ঘোষণা এবং ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়কে সামনে রেখেই জনগণের কাছে যাচ্ছে বিএনপি। এতেই বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর দৃঢ় আস্থা। আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে জয়লাভের বিষয়েও তারা যথেষ্ট আশাবাদী।
একসময়ের ৫ শতাংশ ভোটের দল জামায়াত ধীরে ধীরে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। লক্ষ্য- আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে শক্ত অবস্থান তৈরি করা। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে- ডাকসু ও জাকসুসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অবিশ্বাস্য জয়লাভের ফলে জামায়াত এখন আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে সরকার গঠনের জোরালো স্বপ্ন দেখছে। বিশেষ করে- পতিত হাসিনা সরকারের দল আওয়ামী লীগের সব ভোট দাঁড়িপাল্লায় নেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার- তার সবকিছু করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসলামি এ সংগঠনটি। মোদ্দাকথা- ছাত্রশিবিরের বিজয়ের রেশ ধরে জাতীয় নির্বাচনে একই রকমের অবিশ্বাস্য ভূমিধস বিজয় লাভের মাধ্যমে আগামীতে সরকার গঠন করতে চায় জামায়াত।
ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জামায়াত মূল দলের বাইরেও ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে। নানা অভিযোগের পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অবিশ্বাস্য ফলাফল দেখিয়েছে শিবির। সামনে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাকসু) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চাকসু) ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে ধরাশায়ী করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয়ে উৎফুল্ল জামায়াত। এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে বা সংসদ নির্বাচনে ডাকসুর প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করেন না। বিএনপির মিত্রদের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোটের নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তারা বলছেন, জাতীয় রাজনীতি ও সংসদ নির্বাচনের বিশাল মঞ্চে ডাকসুর প্রভাব পড়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে- ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন সরকারও ভিন্ন কোনো কৌশল নেয় কি না এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবার কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হয় কি না, এমন সন্দেহও তৈরি হয়েছে বিএনপির কারও কারও মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, রাজনীতির মেরূকরণ আর কী হবে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি-এই তিন দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। আবার এর মধ্যে দুই দল একসঙ্গে ফ্রন্ট করতে পারে। আর তারেক রহমান তো আগেই বলেছেন জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন করবেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মতে, শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থিরা এক লাইনে চলে আসতে পারে। অথবা বিরোধী দল হওয়ার জন্য ইসলামপন্থিরা এক ধারায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নির্বাচনের আগে। আবার যারা বৈষম্যবিরোধী আছে তাদের থেকে যেসব দল বের হচ্ছে- তাদের মধ্যেও একটা ঐক্য হতে পারে। বাম ঘরানার অথবা সেকুলার ঘরানার-তাদের মধ্যেও একটা ঐক্য তৈরি হতে পারে। তবে এ অবস্থায় বিএনপির বিপরীতে বিকল্প কোনো শক্তি বা ধারা তৈরি হতে আরও সময় লাগবে। এ বিষয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এনসিপি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চায়। বিভিন্ন দলের সঙ্গে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। অভিন্ন ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলনের আলোচনাও আছে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        