চাঁদাবাজিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রিয়াদ। এক বছরেই হয়ে উঠেছিলেন পেশাদার চাঁদাবাজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন টিভি টকশো-তে চেহারা দেখিয়ে পরিচিতি পাওয়ার পর রীতিমতো আতঙ্ক বনে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের কাছে। আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী হলে তো কথাই নেই। গোপনে তার দাবিকৃত চাঁদা তারা পরিশোধ করতেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান ওরফে রিয়াদের নামে ইতোমধ্যে গ্রিন রোডের সাউথ ইস্ট ব্যাংকের শাখায় একটি হিসাব নম্বরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে গত এক বছরে ২ কোটিরও বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর বাইরেও আরও অন্তত ৩টি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হাসিনা রিজিমের পতনের পরবর্তী সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের টার্গেট করে মাঠে নেমে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন রিয়াদ গং। বেসরকারি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র এবং বৈষম্যবিরোধী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা হওয়ার সুবাধে একাধিক শীর্ষ ছাত্রনেতার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার। তাদের শেল্টারে রিয়াদগং ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। বিশেষ করে শেরেবাংলানগর, তেজগাঁও, ফার্মগেট, ধানমন্ডি এবং গুলশান এলাকায় বিচরণ ছিল রিয়াদ গংয়ের। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই টার্গেট ব্যক্তিকে নানাভাবে নাজেহাল করত। এমনকি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ‘মব’ সৃষ্টিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা হওয়ার সুবাধে বিভিন্ন সংস্থার অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও তাদের প্রশ্রয় দিতে বাধ্য ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তারা ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে ৩৮ জন ব্যবসায়ী ও ৩০ থেকে ৩৫ জন রাজনীতিবিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলে জানা গেছে।
২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক উদ্ধার-ডিএমপি : গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, চাঁদা দাবির ঘটনায় গ্রেপ্তার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান ওরফে রিয়াদের বাসা থেকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চারটি চেক উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় কলাবাগান থানায় আলাদা একটি মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে। ওই চেকগুলো রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। চেক চারটি জনতা ব্যাংকের। দুটি চেকে ১ কোটি করে ২ কোটি, একটি চেকে ১৫ লাখ ও আরেকটিতে ১০ লাখ টাকার পরিমাণ লেখা আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারও দলীয় পরিচয় মুখ্য বিষয় নয়। তদন্ত চলছে। আর কেউ জড়িত আছে কি না, তা তদন্তে জানা যাবে। এ বিষয়ে চাইলে গুলশান থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা একাধিক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। তবে তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। রিয়াদ তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে রংপুরের ওই সাবেক এমপি ফোন করে ৫ কোটি টাকার চেক দেওয়ার তথ্য দেন। এর আগে গত ২৬ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশান এলাকায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজি করার অভিযোগে ছয়জনের নামে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলার সূত্রে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) মো. আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান ওরফে রিয়াদ, ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন মুন্না, সদস্য সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব এবং আমিনুলকে আটক করে। এর মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক আমিনুল ইসলাম রয়েছেন কিশোর সংশোধনাগারে। অপর পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত চারজনকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরই মধ্যে রিয়াদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। ওই ফোনে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে চ্যাটিংয়ের তথ্য রয়েছে। পুলিশ সূত্র মতে, রিমান্ডের ৪র্থ দিনের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। আওয়ামী লীগের এমপি আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন ৫ কোটি টাকার চেক। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের নামে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক উদ্ধার হলেও বাকি ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার চেক এখনো উদ্ধার হয়নি। ওই চেক রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতার কাছে। সেটিও উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া ভাটারা এলাকার আওয়ামী লীগের আরও এক নারী নেত্রীর কাছ থেকেও তারা হাতিয়ে নিয়েছেন ২৭ লাখ টাকা। সেই টাকা সাউথইস্ট ব্যাংকে জমা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
রিয়াদের মায়ের দাবি অস্বীকার আস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের : এদিকে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, গ্রেপ্তার রিয়াদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে পাকা ভবন তৈরির অর্থ নিয়ে তার মা রেজিয়া বেগমের দেওয়া তথ্য সঠিক নয়। এক বিজ্ঞপ্তিতে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন জানায়, তাদের রেকর্ড অনুযায়ী ওই ইউনিয়নে আবদুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদ, তার বাবা আবু রায়হান অথবা তার মা রেজিয়া বেগম নামের কেউ আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের উপকারভোগীদের তালিকায় নেই। রিয়াদ বা তার পরিবারের কারও বিকাশ নম্বরে কোনো লেনদেনও তাদের রেকর্ডে নেই বলে জানিয়েছে আস-সুন্নাহ ফউন্ডেশন। এর আগে রিয়াদের মা দাবি করেছিলেন, বন্যার পর তারা ঘর নির্মাণে টিন সহায়তা পেয়েছেন। এ ছাড়া আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।