একটি দেশ টিকে থাকে ন্যায়বিচারের ওপর। যখন জাতীয় জীবন থেকে ন্যায়বিচার উঠে যায়, তখনই দেশ ও জাতি ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। বনি ইসরায়েলের বিচারব্যবস্থা ছিল ‘অর্থের জোরে হুকুম নড়ে’ এ ধরনের। যার টাকা বেশি ছিল সে বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত কিনে নিত। আর যার টাকা ছিল না তার ওপর সব ধরনের আইনের প্রয়োগ চাপিয়ে দেওয়া হতো। আল্লাহতায়ালা সুরা নিসায় বনি ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক বিচারব্যবস্থা উল্লেখ শেষে উম্মতে মুহাম্মদিকে হেদায়াতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘ওয়া ইজা হাকামতুম বাইনান্নাসি আন তাহকুমু বিল আদলি।’ অর্থাৎ ‘যখন মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করবে ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে করবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৫৮।) এ আয়াতে হুকুম শব্দটি দুইবার এসেছে। হাকামতুম ও তাহকুমু। দুটি শব্দেরই মূল বর্ণ হা-কাফ ও মিম। এ তিনটি বর্ণ দিয়ে আরবিতে হুকুম, হাকিম ও হিকমাহর মতো গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো গঠিত হয়েছে। এ শব্দগুলো বাংলা ভাষায়ও ব্যবহার হয়ে থাকে। হুকুম বলতে শাসন ও বিচারব্যবস্থা দুটোই বোঝায়। একইভাবে হাকিম বলতে বিচারক ও প্রশাসক বুঝিয়ে থাকে। আর হিকমাহ মানে হলো গভীর প্রজ্ঞা। যে গুণটি বিচারক, প্রশাসক ও রাষ্ট্রপ্রধানের থাকা আবশ্যক।
আল্লাহতায়ালা রাষ্ট্রের প্রধান ও বিচারকদের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘যখন তোমরা বিচার-ফায়সালা করবে ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে করবে।’ আয়াতে ‘বাইনান্নাস’ বলা হয়েছে। নাস মানে হলো মানুষ। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, সালাফি-ওহাবি, শিয়া-সুন্নি, সবার জন্য ন্যায়বিচার করতে হবে। নিজের দল বা পীর ভাই হলে বিচার হবে এক রকম আর ভিন্ন মতের হলে বিচার হবে অন্য রকম-এ ধরনের বিচারব্যবস্থা কোরআন সরাসরি হারাম করেছে। ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনব্যবস্থা। সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত আদালতের কাছে জবাবদিহির জন্য বাধ্য থাকতেন। যেমন হজরত আলী (রা.) এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কাজী শুরাইয়ের আদালতে গিয়ে জবাবদিহি করেছেন। আবার ব্যক্তিগতভাবেই শাসকরা তৈরি করেছিলেন ন্যায়বিচারের অনন্য উদাহরণ। যেমন খলিফা ওমর (রা.) চাকরকে উটে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে পথ চলেছেন। মুফাসসিরগণ বলেছেন, ন্যায়বিচার এমন এক বিষয় যা সমাজ ও রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে ভূমিকা রাখে। যে সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে সমাজ ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে থাকে। যে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার হারিয়ে যায়, সে রাষ্ট্রও একসময় ইতিহাসের তাস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হয়। এ ক্ষেত্রে কোরআন খুব স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, বিচারককে হতে হবে নিরপেক্ষ। দলীয়, ধর্মীয়, গোত্রীয় কিংবা ভৌগোলিক পরিচয়ের কারণে বিচারে হেরফের করার সুযোগ নেই। (ফি জিলালিল কোরআন, চতুর্থ খণ্ড, ২২০ পৃষ্ঠা)
আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ দেশের বিচারব্যবস্থায় কোরআনের নির্দেশমতো সত্যিকারের ন্যায় ইনসাফ কায়েম হয়নি। অতীতে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল এমন নৈরাজ্যও দেখেছে দেশের মানুষ। দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও বিরোধী মত দমনের কৌশল হিসেবে বিচারের নামে চলেছে প্রহসন। শত শত নিরপরাধ মানুষ ফাঁসিতে ঝুলেছে এবং হাজার হাজার মানুষ অন্ধকার কারাগারে বন্দি জীবন বরণ করেছে। অন্যদিকে দলীয় লোক হওয়ার কারণে অপরাধের পর অপরাধ করেও ছিল আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব যখন সাধারণ জনগণের সামনে প্রকাশ হতে থাকে তখন জনমনে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। পাশাপাশি দেশে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় গ্রাম্য সালিশ বা পঞ্চায়েত থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দলীয় হুকুম ও অর্থের কাছে ন্যায়বিচার বিক্রি হতে থাকে। ইতিহাসে যখনই এমন ঘটনা ঘটেছে সাধারণ মানুষ তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। জনগণের বিপ্লবে পতন হয় দোর্দণ্ড প্রতাপের স্বৈরাচারী শাসকদের।
গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যখন কোনো রাষ্ট্রে সুরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতের আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হয়, তখন স্বভাবতই জনঅসন্তোষ জন্ম নেয় এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এমন পরিস্থিতিতে বৃহৎ পরিবর্তনের ঝড় ওঠে, যেমনটি আমরা সাম্প্রতিক সময়েও দেখেছি।
আগামী দিনে দেশের শাসনব্যবস্থা যাদের হাতে আসবে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নসিহত হলো-শাসনব্যবস্থায় যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে রাষ্ট্রের আর কোনো কাঠামো সঠিকভাবে কাজ করবে না। আফসোসের কথা হলো, ক্ষমতার চেয়ারে বসার পর কেন যেন বেশির ভাগ মানুষ এই চির সত্যটি ভুলে অন্যায়-অবিচারে ডুবে যায়। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের শাসকদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তাওফিক দিন। দেশের মানুষ যেন শান্তি-সমৃদ্ধির সঙ্গে বসবাস করতে পারেন এমন পরিস্থিতি আপনি তৈরি করে দিন। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কোরআন ফাউন্ডেশন