পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জাহারাল ফাসাদু ফিল বাররি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবাত আয়দিয়ান্নাস। জলে-স্থলে যেসব বিপর্যয় হয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যত দুর্যোগ আসে, সব মানুষের হাতের কামাই।’ আজকের আধুনিক বিজ্ঞানও হাতেকলমে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীতে যত ধরনের বিপর্যয় ঘটে, যত ধরনের অনাচার সৃষ্টি হয়, তার সবগুলোতে কোনো না কোনোভাবে মানুষের হাত রয়েছে। এ সময়ের একজন দার্শনিক ও সুফি গুরু এক আলোচনায় বলেছেন, এ শতাব্দীর মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, তারা নিজেদের আবিষ্কারের ডানায় ভর করে উৎকর্ষতার চরম শিখরে আরোহণ করতে গিয়ে প্রকৃতিকে ভুলে গেছে পুরোপুরি। মানুষ যখন প্রকৃতিকে ভুলে যায়, প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলে তখনই মানব গ্রহে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। অতীতেও এমনটাই ঘটেছে। মানুষ এ সামান্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধন করেই দাবি করছে, তারা আবিষ্কারের স্বর্ণশিখরে অবস্থান করছে। কিন্তু কোরআন পড়লে জানা যায়, আজকের বিজ্ঞানের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী চমকে দেওয়া প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিল পূর্ববর্তী প্রজন্মরা। মানুষ তখন প্রযুক্তিতে এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে তারা নিজেদের অমর পর্যন্ত দাবি করে বসত। আমাদের মতো পূর্ববর্তী প্রজন্মও যখন প্রকৃতিবিরুদ্ধ জীবনযাপন করা শুরু করেছে, আল্লাহতায়ালা তাদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। আদ এবং সামুদসহ আরও অন্যান্য জাতির ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা বলেছেন পবিত্র কোরআনে। আল্লাহ বলছেন, ‘তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক বিশাল বিশাল বিল্ডিংয়ের নির্মাতা আদ জাতির ইরাম গোত্রের কী পরিণতি করেছিলেন। এদের মতো প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জাতি আর কোথাও সৃষ্টি করা হয়নি। আর আমি সামুদ জাতির পরিণতি কী করেছিলাম, তাও কি তুমি দেখনি, তারা কোরা পাহাড়ে পাথর কেটে চোখধাঁধানো প্রাসাদ বানাত। একসময় ওরা প্রকৃতি ভুলে প্রকৃতিবিরুদ্ধ জীবনযাপন শুরু করল। ওরা সীমা লঙ্ঘন করল। আর তোমার প্রভু ওদের ওপর আজাবের চাবুক মারলেন। মুহূর্তেই ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মনে রেখ, তোমার প্রভু সবদিকে সমান দৃষ্টি রাখেন।’ (সুরা ফজর, আয়াত ৬-১৪)।
পবিত্র কোরআনের আরও নানান জায়গায় এভাবে পূর্ববর্তী প্রজন্মের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। এসব বলার উদ্দেশ্য একটাই ছিল-এ প্রজন্মের মানুষ যেন সতর্ক হয় ও সচেতন হয়। আফসোস! আমরাও অতীতের মানুষের মতো ক্রমেই প্রকৃতি ছেড়ে, প্রকৃতির স্রষ্টা আল্লাহকে ভুলে এক চোখধাঁধানো অন্ধকারের দিকে ছুটে চলছি। যার শেষ পরিণতি ধ্বংস ছাড়া কিছুই নয়।
একসময় আমাদের দেশ ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আমাদের মাটি পানি বাতাস ছিল স্বর্ণের খনির মতো দামি। চারদিক ছিল সবুজে ঢাকা। নদী আর খালের শান্ত প্রকৃতি দেখে চোখ-মন দুটোই জুড়িয়ে যেত। আমাদের ছিল গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ। গোসলের আগে খালে-বিলে কয়েক খেপে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত তা দিয়ে বড় পরিবারের দুই তিন দিন অনায়াসে চলে যেত। সেই মাছ ছিল স্বাদে অনন্য। রান্না করলে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত বাড়ি থেকে অনেক দূর পর্যন্ত। মাছে ছিল না কোনো বিষ, ভারী ধাতু কিংবা ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক। শাকসবজি ছিল তাজা। পুষ্টিতে ভরপুর। হায়! এখন আমরা কোন কালো সময়ে চলে এসেছি। আমাদের চালে ভেজাল। সবজিতে ভেজাল। মাছে ভেজাল। ফলে বিষ। কথায় বিষ। ব্যবহারে আগুন। চরিত্রে হিংস্রতা। এক কথায় আমরা জান্নাতি জীবন থেকে হাতে ধরে জাহান্নামের জিন্দেগিতে প্রবেশ করেছি। আর এর নাম দিয়েছি উন্নয়ন! আমাদের শহর কয়েক দিন পরপর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। আমাদের নগর কয়েক দিন পরপর আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আমাদের বাসা-সড়ক কয়েক দিন পরপর পানিতে তলিয়ে যায়। আমাদের ফুটপাত সব সময় হকারের দখলে থাকে। আমরা সড়ক দিয়ে হাঁটতে পারি না। আমরা শহরে কোথাও মন খুলে আয়েশ করে বসতে পারি না। আমাদের জীবন হয়ে গেছে দুর্যোগের জীবন। দুর্ঘটনার জীবন। অসংখ্য দুর্ঘটনা, আসমানি বিপদ, জমিনি বিপদ তো ঘটছেই, পাশাপাশি মানুষ মানুষের প্রতি হিংস্রতার চূড়ান্ত রূপও দেখিয়ে চলছি আমরা। আপনজনরা আপনজনদের খুন করছে অবলীলায়। শুধু খুন করেই শান্ত থাকছে না, লাশের ওপর নির্মম নির্যাতন পর্যন্ত করছে। এভাবে চলতে থাকা মানে কিন্তু প্রভুর আজাবের চাবুকের ঘা খাওয়ার সময় খুব কাছেই চলে এসেছে। এখনো সময় আছে, আমরা যদি তওবা করে প্রভুর কাছে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ফিরে আসি, আমাদের প্রযুক্তি যদি প্রকৃতি রক্ষা করার প্রযুক্তি হতে পারে, আমাদের জীবনযাপন যদি প্রকৃতিবিমুখ না হয় তাহলে আশা করা যায়, ইউনুস নবীর উম্মতের মতো আমরাও ধ্বংসের একেবারে খুব কাছে গিয়েও ক্ষমার চাদরে আশ্রয় পাব।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট