শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৪৫ বছরের জীবনকালে প্রমাণ করে গেছেন তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক, রাষ্ট্র গঠনে, দেশবাসীর উন্নয়নে দক্ষ, উদ্ভাবনমূলক চিন্তার এক দার্শনিক-নেতা। আপাদমস্তক সৎ অসামান্য মেধা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে তিনি রাষ্ট্রকর্মে যা অর্জন করেছিলেন তা নজিরবিহীন। এই রাষ্ট্রনায়কের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী গেল সেদিন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি সামরিক বাহিনীর এক কুচক্রী অমুক্তিযোদ্ধা জেনারেলের এবং তার সহযোগী স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নিহত হন। তবে ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ে আজও মর্যাদার আসনে রয়েছেন। তিনি এখনো আমাদের পথনির্দেশক, সবার স্বপ্নদ্রষ্টা। বগুড়ার রসায়নবিদ পিতা ও নজরুলসংগীতশিল্পী মাতার পরিবারে মধ্য তিরিশ দশকে জন্ম নেওয়া জিয়া (যার ডাকনাম কমল) কলকাতা ও করাচির শিক্ষালয়ে বিদ্যার্জনের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে। পরবর্তীকালের সেনা কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
কর্মজীবনের শুরুতেই বলা যায়, সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে অসামান্য সাফল্যের প্রমাণ রাখেন। তারপর তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কাজটি করার ডাক এলো ১৯৭১ সালের মার্চের ২৫ তারিখ দিবাগত রাতে ২৬ মার্চের প্রারম্ভকালে। সেই রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারা দেশে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ডেপুটি কমান্ডার মেজর জিয়া শেষ রাতে চট্টগ্রাম নগরীতে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেন। তখন সমগ্র চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশে প্রচণ্ড জনবিদ্রোহ, গণপ্রতিরোধ পাকিস্তানি হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। সারা দেশেও পাকবাহিনীর হামলার মুখে গণপ্রতিরোধ লড়াই শুরু হয়।
চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার সহযোগী ছিলেন বেশ কয়েকজন বাঙালি জুনিয়র অফিসার এবং প্রায় ৩০০ বাঙালি সেনা জওয়ান। তারা তুমুল যুদ্ধ শুরু করলেন জিয়ার নেতৃত্বে। গোটা চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ তখন জিয়ার নেতৃত্বে সাহসী হয়ে এগিয়ে এলেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সংগ্রামী বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদ ও অন্যদের সহযোগিতায় মেজর জিয়া প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। সেই ঘোষণা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। লড়াকু বাঙালি পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে সংগঠিত হতে লাগল, যুদ্ধ শুরু করলেন তাঁরা সবাই।
জিয়াউর রহমান প্রথমে ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করতে করতেই মুক্তিবাহিনীর তিন ব্রিগেডের একটি ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’-এর কমান্ডার হলেন একাত্তরের জুলাই মাসে। প্রথমে সেক্টর কমান্ডার এবং পরে সফল ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের সম্মুখসমরে ১ নম্বর কমান্ডারের পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করেন এবং প্রথম বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর উত্তম’ খেতাব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরেই জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত হন। অচিরেই তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদ লাভ করেন। এরপরে সর্বোচ্চ দায়িত্ব জেনারেল জিয়ার কাঁধে তুলে দেয় গোটা জাতি। সেটা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার গণ অভ্যুত্থানে তাঁকে সেই অবস্থানে বসানো হয়। বিশ্বসেরা কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন-জিয়াউর রহমান সেই অবস্থানে দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পেলে বাংলাদেশ অন্য অনেক ব্যর্থ রাষ্ট্রের মতো ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াত, দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যেত।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার আগেই দেশের সামরিক বাহিনীকে সুসংগঠিত করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন এবং উৎপাদনের অর্থনীতি পুনর্গঠনে জোর প্রচেষ্টা চালান। একই সঙ্গে কৃষি ও শিল্পকারখানা ব্যবস্থাপনার উন্নতি বিধানে উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়ন আরম্ভ করেন। তিনি গণমানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে দেশব্যাপী মরা খালগুলো কেটে নাব্য সৃষ্টি, নৌ-চলাচল সুবিধার ব্যবস্থা ও কৃষি-সেচ কাজের উন্নয়ন ঘটান। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। জিয়াউর রহমান অন্তত ১০ হাজার গ্রামে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবাসীর উন্নয়নে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে সেসব বাস্তবায়নে আমলাদের অধিক পরিশ্রমে বাধ্য করেন। নিজে রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করে যান। নজিরবিহীন সেই প্রচেষ্টা। তারপরে জিয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়া আওয়ামী লীগ ও সেই ঘরানার রাজনীতির প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনী ওসমানীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জেনারেল ওসমানীর বাড়ি গিয়ে তাঁর দোয়া নিয়ে আসেন।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে জয়লাভ করে। সারা দুনিয়া প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট দুটো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়েই সন্তোষ প্রকাশ করে। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক