জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার ইলিয়াস কাঞ্চন। সম্প্রতি সরকার তাঁকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২৩-এর জুরিবোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু সে পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান তিনি। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন ছাড়াও চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন তিনি। তাঁর এ বিশেষ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২৩-এর জুরিবোর্ড থেকে সরে গেলেন, বিশেষ কোনো কারণ ছিল কি?
দেখুন, এ অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করল তখন তথ্যসচিব আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন আমরা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন কীভাবে করতে পারি। আমি বললাম এর জন্য প্ল্যান প্রোগ্রাম দরকার। তিনি বললেন, আমাদেরও একটা প্ল্যান আছে, আপনাদেরটাও দেন, আমরা দুটো মিলিয়ে একটি প্ল্যান তৈরি করব। এরপর হঠাৎ দেখলাম কোনো কথাবার্তা ছাড়াই সরকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২৩ এর জুরি বোর্ডের সদস্যদের নাম ঘোষণা করলেন। আমি অবাক হলাম, ভাবলাম চলচ্চিত্রকারদের বাদ দিয়ে তারা যদি নিজেরাই সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাহলে আমার কাছে প্ল্যান চাইলেন কেন। মূলত এ কারণেই এ পদ থেকে সরে গেলাম। তাছাড়া এ ধরনের কোনো কমিটিতে আগেও আমি কখনো থাকিনি। অনেক প্রস্তাব এসেছিল আমি বরাবরই না করে দিয়েছি। এমনকি আমি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি থাকাকালীনও পদাধিকারবলে আমাকে এমন অনেক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি তা নাকচ করে দেই। আমি রাজনৈতিক বা এ ধরনের কোনো কাজে মোটেও আগ্রহী নই। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর মতো জনকল্যাণমূলক কাজে আমাকে ডাকা হলে আমি অবশ্যই তা করব।
সরকারের কাছে আপনি কেমন প্ল্যান দিতে চেয়েছিলেন?
আমি চেয়েছিলাম জুরি কমিটি, সেন্সর কমিটি ও সার্চ কমিটি সময়োপযোগী করে গঠন করতে। সার্চ কমিটির কাজ হবে অন্য সব কমিটির তদারকি করা।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরিবোর্ড আগে নানা কারণে বিতর্কে ছিল, কী বলবেন?
এ বিতর্কের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, তবে অনেক অনিয়ম যে হয় তা দেখেছি। যেমন একসময় দেখেছি এখানে নির্মিত ভারতীয় রিমেক ছবিকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হতো। কিন্তু আমি যখন এ ধরনের একটি রিমেক ছবি নির্মাণ করে জমা দিলাম তখন তা বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। আসলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান কমিটিতে সরকার ও সরকারদলীয় লোকদের প্রাধান্য থাকে। তাদের মন মতো প্রায় সময়ই এ পুরস্কার প্রদান করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারকে বিতর্কিত করা হয়েছে।
চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারপ্রদত্ত অনুদান নিয়েও নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে...
এ অভিযোগ অবশ্যই সত্যি। সরকারি অনুদান নিয়ে বেশিরভাগ নির্মাতাই এর অপব্যবহার করে। যা নির্মাণ করা হয় তা কতটা মানসম্মত হয়? এসব ছবি কি দর্শক দেখে? সব টাকা কি এতে ব্যবহার করা হয়? হিসাব করলে দেখা যাবে অনুদান নিয়ে সিংহভাগ ছবিও নির্মাণ করা হয়নি। এর জন্য আইনগত ব্যবস্থা ও তদারকির ক্ষেত্রও অত্যন্ত দুর্বল। আর অনুদান প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সরকারি লেজুড়বৃত্তিকে বেশিরভাগ সময় প্রশ্রয় দেওয়া হয়। আসলে অনুদান দেওয়ার সিস্টেমই ঠিক নেই। আর যেখানে সিস্টেম ঠিক থাকে না সেখানে তো দুর্নীতি হবেই। এটি সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। দুঃখের কথা সরকারি হলেও এ অর্থ তো সরকারের নয়, এটি জনগণের টাকা, এর অপব্যবহার করা কি উচিত?
অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে আপনার কোনো প্রস্তাব আছে কি?
আমি বলব যেসব ছবি মুক্তি পেয়ে ভালো ব্যবসা করে সেগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করে সেসব ছবিকে অনুদান দেওয়া হোক। এছাড়া আমি সরকারকে বলেছিলাম চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান নয়, ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হোক। এ টাকা একসঙ্গে ব্যবহার করা হবে না। টাকাটা ব্যাংকে রাখা হবে। প্রথম বছর এ টাকা থেকে ৩০টি ছবি নির্মাণ করা হবে। সেই ছবির লাভের টাকা দিয়ে দ্বিতীয় বছর আবার ৩০/৪০টি ছবি নির্মাণ করা হবে। এবং পরে আবার লাভের টাকা এবং ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা বাকি টাকার ইন্টারেস্ট দিয়ে ছবি নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে ধাপে ধাপে সুদসহ ঋণের টাকা সরকারকে ফেরত দেওয়া হবে। আর সরকারি এ অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এভাবে ১০ বছরের মধ্যে সরকারকে সুদসহ সব টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
কিন্তু অনুদানের বেশির ভাগ ছবি মৌলিক ধারার, যা রুট লেভেলের দর্শক দেখে না, তাহলে অর্থ কীভাবে সরকারকে ফেরত দেওয়া হবে?
কথাটি খুবই সত্যি, আমি বলব চলচ্চিত্রকে যদি সত্যিকার অর্থে দাঁড় করাতে হয় তাহলে কমার্শিয়াল ছবিকেই অনুদান দিতে হবে। কারণ কমার্শিয়াল ছবিই সব শ্রেণির দর্শক দেখে, এতে লোকসান গোনার ঝুঁকি থাকবে না। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি- আমার অভিনীত প্রথম ছবি ‘বসুন্ধরা’ কিংবা পরের ছবি ‘ডুমুরের ফুল’- এর জন্য আমাকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়নি। কারণ এগুলো ছিল মৌলিক ধর্মী ছবি। আমি পুরস্কার পেয়েছি কমার্শিয়াল ছবির জন্য। এটা ছিল একটা সিলি ব্যাপার। আরও দুঃখের বিষয় হলো, যে কোনো কমিটিতে মেইনস্ট্রিমের চলচ্চিত্রের লোকদের রাখা হয় না। এখনো যে যে কাজের যোগ্য তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো হচ্ছে না। সরকারের পছন্দমাফিক কিংবা দলীয় ঘরানার লোকেরাই সব ক্ষেত্রে সুযোগ পাচ্ছেন। তাই যথার্থতা ও দক্ষতার অভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করা যাচ্ছে না।
সফলতার ক্ষেত্রে তাহলে কমার্শিয়াল ছবিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন?
অবশ্যই, এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের একটি দিকের কথাই উল্লেখ করি, যেমন কোনো শিল্পী যদি কমার্শিয়াল ছবিতে কাজ করতে আসেন তাহলে তাকে অভিনয়, ফাইট, ড্যান্স থেকে শুরু করে সবকিছুরই প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মৌলিক ছবির ক্ষেত্রে এর খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তাই কমার্শিয়াল ছবির ক্ষেত্রে শিখে কাজ করতে হয় বলে ছবিগুলোর সব দিক যথাযথ হয় এবং সব শ্রেণির দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাই সরকারকে বলব অনুদান কিংবা পুরস্কার, মানে সব ক্ষেত্রেই কমার্শিয়াল ছবিকে অগ্রাধিকার দিন। চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনুন।