বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাকালে কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রভাব খাটানো থেকে শুরু করে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী আমলা হওয়ায় সেসময় তাকে নিয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে থাকাকালে তার পছন্দের ব্যক্তিরা ছাড়া কেউই ঠিকাদারি কাজ পেতেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন, সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন প্রকল্প, নদী খনন, ব্রিজ নির্মাণ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাঁকা অংশ সোজাকরণ এবং বেড়িবাঁধে রাস্তা পাকাকরণসহ সব কাজের বেশির ভাগ টাকা গেছে কবির বিন আনোয়ারের পকেটে। ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে অনেকের মতো আত্মগোপনে রয়েছেন কবির বিন আনোয়ারও। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জে দুই বিএনপি কর্মী ও একজন যুবদল নেতা হত্যার ঘটনায় তিন মামলায় আসামিও হয়েছেন সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব থাকাকালে কবির বিন আনোয়ার কক্সবাজারের প্যাঁচার দ্বীপে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নজিরবিহীন প্রতারণা করেছেন। সাগরের উপকূল এলাকার ভাঙন রোধে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জরুরি কাজের আবেদন নিয়ে তিনি নিজের রিসোর্ট রক্ষা করেছেন। এর ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জরুরি বরাদ্দের এই প্রকল্প আবেদন অনুযায়ী স্থানীয় অধিবাসীদের কোনো কাজে আসেনি। গতকাল সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। সংস্থাটির দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলের পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডলের সই করা এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, কবির বিন আনোয়ার ১৯৮৫ ব্যাচে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। গত বছর ৩ জানুয়ারি কবির বিন আনোয়ারকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ওই পদে তিনি ছিলেন মাত্র ১৯ দিন। এরপর তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, কবির বিন আনোয়ার পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব থাকাবস্থায় ২০২০ সালে ফেনী জেলায় টেকসই মুহুরী বাঁধ ও নদী ড্রেজিংসহ বন্যা প্রতিরোধে ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন প্রকল্প নামে ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে নদী খনন, ব্রিজ নির্মাণ, মুহুরী নদীর বাংলাদেশ (ফেনী) অংশে ৯২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাঁকা অংশ সোজাকরণ, লুফ, বেড়িবাঁধে রাস্তা পাকাকরণসহ সব কাজের জন্য বরাদ্দ নেওয়া হয় ৩৫০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পের কাজ নিজের পছন্দের লোকদের দেন কবির বিন আনোয়ার। কাজ ঠিকমতো না করেই টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। সূত্র জানায়, তৎকালীন পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের নির্দেশে রামু উপজেলার রেজু খালের মোহনা এবং প্যাঁচার দ্বীপে সাগরের উপকূল ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও টিউবের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জরুরি এই কাজের দৈর্ঘ্য ৩৩০ মিটার। ব্যয় হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। কবির বিন আনোয়ার জোরপূর্বক গরিব কৃষকের জমি দখল করে সেখানে তার রিসোর্টের রাস্তা বানান। রিসোর্টটির নাম ‘লাইট হাউজ’। কক্সবাজার গেলে তিনি সেখানেই থাকতেন।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, কবির বিন আনোয়ার ২০০০ সালের ৩০ নভেম্বর খুনীয়াপালং ইউনিয়নের প্যাঁচার দ্বীপ মৌজায় আরএস ২৬টি দাগ থেকে ২৯৬৬ নম্বর দলিলে ২০ শতক জমি কিনেন মাত্র ৩০ হাজার টাকায়। এরপর সেখানেই তিনি রিসোর্ট বানিয়েছেন। ২০০৯ সালে রামু ভূমি অফিস থেকে এই জমি তার নামে নামজারিও করেন। তার ছেলে সামদ বিন কবিরের নামেও সেখানে জমি কেনা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২১ মে ১০৩০ নম্বর দলিলে রামু সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিলটি সম্পন্ন হয়। একই মৌজায় ৬৪৪ ও ৬৪৫ দাগে ২৩ লাখ ২৭ হাজার টাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ শতক (৫ হাজার ৭৭১ দশমিক ৭০ বর্গফুট) জমি কেনা হয়। জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী সামদ বিন কবিরের বয়স এখন ১৯ বছর। ২০০২ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া সামদ বিন কবির মাত্র ১২ বছর বয়সে রেজিস্ট্রিমূলে এই জমির মালিক হন। দলিলের চৌহদ্দিতে বলা হয়েছে- পশ্চিমে কবির বিন আনোয়ার। অর্থাৎ পিতা-পুত্র পাশাপাশি জমির মালিক। ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল জমিটি নামজারি সম্পন্ন হয়। মূলত ছাত্র অবস্থায় সচিবের ছেলে দামি এই সম্পদের মালিক হয়েছেন।