অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারির মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈতনীতির কারণে বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং বৈষম্য দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি বিভাগ ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়নের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দ্বৈতনীতির বৈষম্য নিরসনে জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) খালিদ আহম্মেদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে জ্বালানি বিভাগ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গত ৭ অক্টোবরের এক অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়, এই কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন জ্বালানি বিভাগের উপসচিব (অপারেশন-১)। এ ছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা), জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব (অপারেশন-১), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট উইংয়ের একজন প্রতিনিধি ও কাস্টম উইংয়ের একজন প্রতিনিধি, ক্যাবের একজন প্রতিনিধি, সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) ও দেশের পাঁচটি বেসরকারি রিফাইনারির পাঁচজন প্রতিনিধি। গঠিত কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, ট্যারিফ ও ইনভয়েস ভ্যালুতে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি শুল্কায়নে সুবিধা বা অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনা করা এবং বিপিসি ও বেসরকারি প্ল্যান্টের আমদানিকৃত জ্বালানি তেল শুল্কায়নে সৃষ্ট জটিলতা বা বৈষম্য নিরসনে মতামত বা সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে কমিটিকে উল্লিখিত বিষয় পর্যালোচনা করে মতামত বা সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জরুরিভিত্তিতে জ্বালানি বিভাগে দাখিল করতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, এই কমিটির মূল্যায়ন ও সুপারিশের ভিত্তিতেই পরবর্তীতে দ্বৈতনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই কমিটির মাধ্যমে শিগগির দ্বৈতনীতির বৈষম্য দূর হবে বলে আশা করছেন বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকরা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈতনীতির কারণে বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্সও দিতে হচ্ছে। ফলে বিপুল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই খাতটিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে যে পরিমাণ শুল্ক দিচ্ছে, বেসরকারি পর্যায়ে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে তারা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। একই দেশে সরকারি ও বেসরকারি শুল্ক মূল্যায়ন পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে না। এতে দেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে পাঁচটি রিফাইনারি রয়েছে। সেগুলো হলো- সুপার পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড, বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, পারটেক্স পেট্রো লিমিটেড, পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি লিমিটেড এবং এ্যাকোয়া রিফাইনারি লিমিটেড। জানতে চাইলে পারটেক্স গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার ঘোষ বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারির মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈতনীতি থাকার কারণে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকরা দুই দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপরিশোধিত তেল আমদানির সময় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করার কারণে আমাদের শুল্ক বেশি দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমরা যখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করে বিপিসির কাছে বিক্রি করি তখন তারা আমাদের ট্যারিফ ভ্যালুতে প্রাইসিং করে টাকা ফেরত দেয়। এতে আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ মূল্য শুল্কায়নে দুই নীতির কারণে পুরো সক্ষমতায় আমরা উৎপাদনে যেতে সাহস পাচ্ছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার রিফাইনারিতেই দৈনিক ১২ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল উৎপাদন করছি। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেশি। বাড়তি শুল্কের কারণে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। বেসরকারি রিফাইনারিগুলোতে যত বেশি পরিশোধন করবে, সরকারের তত লাভ। কারণ, বেসরকারি রিফাইনারি থেকে বিশ্ববাজারের চেয়ে ১ শতাংশ কম মূল্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনতে পারছে সরকার। এখানে সরকারকে ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে না, কারণ রিফাইনারিগুলো ডলারে নয়, টাকায় তেল দিচ্ছে বিপিসিকে।’ সুবীর কুমার ঘোষ বলেন, ‘শুল্কনীতির বৈষম্য যখন থাকবে না, তখন বেসরকারি রিফাইনারিগুলো অকটেনের চাহিদার পুরোটিই দেশে উৎপাদন করতে পারবে। এতে অকটেন আমদানির প্রয়োজন হবে না, সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।’ অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দেশে একই পণ্যের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি থাকা ঠিক নয়। দ্রুত এই নীতি পরিবর্তন করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে এক নীতি বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তারা। সরকারি ও বেসরকারি মূল্য শুল্কায়ন একই পদ্ধতিতে হতে হবে। হয় তা ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে, না হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে। জানা যায়, বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস খালাস করার সময় ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্কায়ন করে। অন্যদিকে একই এইচএস কোডে যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে তাদের শুল্কায়ন করা হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে। এর সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধসাপেক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয় কাস্টমস হাউস। পণ্যের ইনভয়েস ভ্যালুর ক্ষেত্রে পণ্যের ওপর আরেপিত কাস্টমস ডিউটি সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে বিপিসি। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরবর্তী সময়ে বিপিসিকে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের জন্য ডিমান্ড নোট করে থাকে। যা বিপিসি তার প্রাইসিং ফর্মুলায় অন্তর্ভুক্ত রাখে না। এখানে সরকারের সঙ্গে এনবিআরের দ্বৈতনীতি পরিলক্ষিত হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে অবশ্যই সরকারকে মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈতনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সবার জন্য একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়ন করতে হবে। তাহলেই অর্থসংকট কেটে যাবে এবং জ্বালানি তেল পাচার রোধ করাও সম্ভব হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘এক দেশে একই পণ্যের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি থাকা ঠিক নয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কোনো চিন্তাভাবনা থেকে এমন নীতি করেছে এটি ভালো করে দেখা দরকার।’ বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ চলতি বছরের মার্চ থেকে শুরু করেছে সরকার। সে হিসেবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা, অকটেন ১২৫ টাকা ও পেট্রলের লিটার ১২১ টাকা। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭২ লাখ মেট্রিক টন। মোট চাহিদার প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেলই ব্যবহার হয়। বাকিটুকু চাহিদা পূরণ হয় পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলে।