২০২০ সালের ১৬ মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিয়েই ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেন। এর একদিন পর সংস্থাটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারকে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত করেন। এরপর গত চার বছরে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। তাদের চাকরিচ্যুত করেই নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। টেন্ডার, ইজারা, নিয়োগ, দোকান বরাদ্দসহ অসংখ্য কাজ করেন তিনি আত্মীয়স্বজন ও তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। পুরো সংস্থায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতির রামরাজত্ব করেন তাপস।
জানা যায়, ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নিজেকে রীতিমতো ‘রাজা’ ভাবতে থাকেন শেখ ফজলে নূর তাপস। মেয়র হওয়ার পর দেশের বুদ্ধিজীবী, আলেম, বিচার বিভাগ, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, পরিবেশবিদসহ সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন। কারও কোনো কথা, পরামর্শ, অনুরোধ পাত্তাই পেত না তার কাছে। শেখ তাপসের আচরণ ছিল খুবই স্বৈরাচারী। তিনি ছিলেন খুবই হিংসাত্মক। তার আগের মেয়াদের মেয়র সাঈদ খোকন যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা একটা করে সব বন্ধ করে দেন তাপস। এ কারণেই ডিএসসিসির অনেক মার্কেটের উন্নয়ন কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এতে করে সিটি করপোরেশনের কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন দক্ষ-অদক্ষ লোক হিসেবে ১ হাজার ২৭০ জনকে চাকরি দিয়েছিলেন। মেয়র তাপস আসার পর শুধু সাঈদ খোকন চাকরি দেওয়ার কারণে ৯০০ লোকের চাকরি খেয়ে ফেলেন। পরে নিজে ৪০০ লোকের চাকরি দেন। শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্থায়ী ৪৪ জনের চাকরিও খেয়েছেন তাপস।
পছন্দের লোক ও রাজনৈতিক পরিচয়ে চাকরি : গত চার বছরে ভারী গাড়ির ১৪৩ জন চালক, ৬৬ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ৭৭ জন হিসাব সহকারী, ২৭ জন রেভিনিউ সুপারভাইজার, ৩১ জন পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক, ২০ জন স্প্রে-ম্যান সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন বিভাগে সর্বমোট ৮৭৯ জন জনবল নিয়োগ দেন। নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী মেয়রের পছন্দের লোক ও রাজনৈতিক পদবিধারী। এর মধ্যে চলতি বছরের ৫ মে ইপিআই সুপারভাইজার পদে ১৮ জন লোকবল নিয়োগ দেয় সংস্থাটি। এ ১৮ জনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকার ১৪ জন। এর মধ্যে ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট এলাকার পাঁচজন। বাকি চারজনের মধ্যে একজন গোপালগঞ্জের, বাকি তিনজন অন্য জেলার।
এ ছাড়া গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ৩৪ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর) পদে নিয়োগ দেয় ডিএসসিসি। এদের মধ্যে বেশির ভাগই রাজনৈতিক তদবির ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় নিয়োগ দেন তিনি। একই সঙ্গে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি অফিস সহকারী পদে ৬৫ জন লোকবল নিয়োগ দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে সরাসরি তাপসের লোক হচ্ছে ২৬ জন। বাকি ৩৯ জন আওয়ামী লীগ নেতাদের তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগ হয় বলে সংস্থাটি সূত্রে জানা যায়। এ ছাড়া পার্কিং, মাঠ ও পার্ক, ফুডকোর্টসহ অনেক স্থাপনা ইজারা দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। একই সঙ্গে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের টেন্ডার কার্যক্রম করে সংস্থাটি। এসব ইজারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা পাওয়ার কথা থাকলেও অনেকে পায় না। কারণ শুধু মেয়র তাপসের অনুসারী নেতা-কর্মীরা এসব ইজারা পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারসের সামনের খালি জায়গা ইজারা নেয় মেয়রের পছন্দের কাউন্সিলর নারগিস মাহতাব। ওই সময় তিনি কাউকে দরপত্র কিনতে দেননি। মতিউর রহমান পার্ক ইজারা নেন ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হকের লোকজন। ধূপখোলা মাঠের উন্নয়ন কাজ করেন ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক। তার রয়েছে মেসার্স প্রভাতী অ্যান্ড কোং এবং মেসার্স তালুকদার অ্যান্ড কোং নামের কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠান। পুরো সিটি করপোরেশনের ইজারা, টেন্ডার কার্যক্রম সব তাপসের পছন্দের লোকজনই পেতেন। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ৯৩টি মার্কেট রয়েছে। এর মধ্যে মেরাদিয়া বাজার, খিলগাঁও কাঁচাবাজার, সিদ্দিকবাজার, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ কমপক্ষে ১০ মার্কেট তাপসের আমলে নির্মাণাধীন। ইতোমধ্যে এসব মার্কেটের দোকান বরাদ্দপত্র শেষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি মার্কেটের ৩০ শতাংশ দোকান মেয়র কোটায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর এসব বরাদ্দ তার আত্মীয়, কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতারা পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন আগে দেশ ছাড়েন তাপস। দেশে না থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।