ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর মধ্যে নামাজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। যে পাঁচটি ভিত্তির ওপর ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে এর মধ্যে নামাজ দ্বিতীয়। নামাজ ছাড়া ইসলামের মৌলিকত্ব অসম্ভব। ঈমানের পর ইসলামে নামাজের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো ইবাদত নেই।
কোরআন মাজিদে ৮৩ বার নামাজের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে।
নামাজেই ঈমানের পরিচয় : পবিত্র কোরআনে মুমিন-মুত্তাকির পরিচয় দিতে গিয়ে ঈমানের পরই নামাজের কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(মুত্তাকি তারা) যারা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যা কিছু দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩)
নামাজই ঈমানের পরিচয় বহন করে।
যে সঠিকভাবে নামাজ আদায় করে সেই প্রকৃত মুমিন। যে নামাজ আদায় করে না সে পূর্ণ মুমিন নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনরা সফলকাম হয়েছে। যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ১-২)
নামাজ সবার জন্য সব সময় : ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামাজ ও রোজা ধনী-গরিব সবার জন্যই ফরজ। তবে হজ ও জাকাতের বিধান শুধু ধনী ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য। শারীরিক অসুস্থতাসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফরজ রোজা ভঙ্গ করার হুকুম রয়েছে এবং পরে তা আদায় করে নেওয়া যায়। রোজা ভঙ্গের পর কাফ্ফারা আদায় করার বিধানও রয়েছে। তবে নামাজের ক্ষেত্রে কাজা করার হুকুম শুধু বিশেষ ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়েছে।
যদি কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে না পারে; সে যেন বসে নামাজ আদায় করে। যদি কারো বসে নামাজ আদায় করতে কষ্ট হয়; সে যেন শুয়ে নামাজ আদায় করে। দেহে জ্ঞান থাকা পর্যন্ত কোনো অবস্থায় কোনো ব্যক্তির জন্য নামাজ বাদ দেওয়ার বিধান নেই। আল্লাহ বলেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)
নামাজের বিধান ঊর্ধ্বলোকে : মহান আল্লাহ নবী (সা.)-কে সাত আসমান পার করে ঊর্ধ্বলোকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে নামাজের বিধান দিয়েছেন। অন্য কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। সুতরাং নামাজ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মিরাজের রাতের প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অতঃপর আল্লাহ আমার উম্মাতের ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দেন। অতঃপর তা নিয়ে আমি ফিরে আসি। অবশেষে যখন মুসা (আ.)-কে অতিক্রম করি; তখন তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা আপনার উম্মতের ওপর কী ফরজ করেছেন? আমি বললাম, ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। তিনি বলেন, আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান; কেননা আপনার উম্মত তা পালন করতে পারবে না। আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহ তাআলা কিছু অংশ কমিয়ে দিলেন। আমি মুসা (আ.)-কে পুনরায় অতিক্রম করাকালে তিনি আবার জানতে চাইলেন, আর আমি বললাম, কিছু অংশ কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনি পুনরায় আপনার রবের কাছে ফিরে যান। কারণ আপনার উম্মত এটিও আদায় করতে পারবে না। আমি ফিরে গেলাম। তখন আরো কিছু অংশ কমিয়ে দেওয়া হলো। আবারও মুসা (আ.)-কে অতিক্রম করাকালে তিনি আবার জানতে চাইলেন। বললাম, কিছু অংশ কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনি পুনরায় আপনার প্রতিপালকের কাছে যান। কারণ আপনার উম্মত এটিও আদায় করতে সক্ষম হবে না। তখন আমি পুনরায় গেলাম, তখন আল্লাহ বলেন, এই পাঁচই (নেকির দিক দিয়ে) ৫০ (বলে গণ্য হবে)। আমার কথার কোনো রদবদল হয় না। (মুসলিম, হাদিস : ১৬৩)
নামাজ পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যম : নিজেকে পরিশুদ্ধ করার একমাত্র ইবাদত নামাজ। নামাজের মাধ্যমেই মানুষ সব পাপ থেকে মুক্ত থেকে পবিত্র জীবন যাপন করতে পারে। নামাজ আদায় করতে থাকলে একসময় এই নামাজই মানুষকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ (মানুষকে) অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৪৫)
নামাজ পাপ থেকে মুক্তির উপায় : নামাজ মানুষকে পাপ মুক্ত করে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে। হাদিসে এসেছে—আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আচ্ছা তোমরা বলো তো—যদি কারোর বাড়ির দরজার সামনে একটি নদী থাকে, যাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার করে গোসল করে, তাহলে তার শরীরে কি কোনো ময়লা অবশিষ্ট থেকে যাবে?’ সাহাবিরা বলেন, কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের উদাহরণও তেমনই। এর দ্বারা আল্লাহ পাপরাশি নিশ্চিহ্ন করে দেন।’
(বুখারি, হাদিস : ৫২৮)
নামাজ সব সমস্যার সমাধান : আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতি হলো—নামাজের মাধ্যমে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। যেকোনো বিপদ-আপদে ও সমস্যায় পড়লে আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহের প্রত্যাশায় নামাজে মগ্ন হওয়া চাই। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিকভাবেও চেষ্টা করতে হবে। এতে আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতা সহজে পাওয়া যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৫৩)
হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজ আদায় করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৩১৯)
গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ আদায় : কোরআন মাজিদে যেভাবে নামাজিদের প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি নামাজে অবহেলাকারীদের প্রতি ধমকি ও হুঁশিয়ারিমূলক বক্তব্যও এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর দুর্ভোগ ওই নামাজিদের জন্য, যারা তাদের নামাজ সম্পর্কে উদাসীন।’ (সুরা : মাউন, আয়াত : ৪-৫)
এ জন্য খুব গুরুত্বসহ সময়ের প্রতি লক্ষ রেখে, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে হবে। নামাজে মনোযোগ ফেরাতে ইহসানের বিকল্প নেই। ইহসানের ব্যাখ্যায় হাদিসে বলা হয়েছে—উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, জিবরাইল (আ.) নবীজি (সা.)-কে বলেন, ‘আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।’ তিনি (সা.) বলেন, ইহসান হলো—‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো। আর তুমি যদি তাকে না-ও দেখো, তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন