দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে আজ টানেল যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হওয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষার বঙ্গবন্ধু টানেলের একটি টিউবের কাজ শেষ হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ সকালে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যাতে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের সাংহাই নগরীর আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’-এ প্রবেশ করছে বাংলাদেশও। এ টানেলকে দেশের অর্থনীতির জন্য গেমচেঞ্জার হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যটন শিল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন তারা। টানেল পরিদর্শন শেষে গতকাল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউস বলেন, ‘টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। প্রথম টিউবের কাজের সমাপ্তি হওয়ায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন। স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাওয়ার নবদিগন্ত যুক্ত করেছে কর্ণফুলী টানেল। অবকাঠামো উন্নয়নের চূড়ান্ত মাইলফলক বঙ্গবন্ধু টানেল। ঢাকা-কক্সবাজার ৪০ কিলোমিটার রাস্তা কমে যাবে। জানুয়ারি থেকে পুরোদমে যান চলাচল করবে।’ চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘পদ্মা সেতুর পর আরেকটা মাইলফলক হবে বঙ্গবন্ধু টানেল। এটি হবে অর্থনীতির গেমচেঞ্জার।’ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেলের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা আরও আধুনিক এবং সহজ হবে। বিকশিত হবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। কক্সবাজারের মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে নির্মাণাধীন শিল্পকারখানা বিশেষ সুবিধা পাবে টানেলের কারণে। টানেল ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে চলছে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। এ ছাড়া বিকশিত হবে আনোয়ারায় কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডসহ (সিইউএফএল) নদীর ওপারে গড়ে উঠা শিল্পকারখানার কার্যক্রম। মিয়ানমার হয়ে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শিল্পোন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বৃদ্ধি পাবে রপ্তানি। দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে। ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক আইআরআর-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক ‘বেনিফিট কস্ট রেশিওর (বিসিআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ দশমিক শূন্য ৫ এবং ১ দশমিক ৫। কর্ণফুলী টানেল জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যেভাবে টানেলের যুগে বাংলাদেশ : ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের এক জনসভায় কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের ঘোষণা দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালে প্রস্তাবনাটি প্রকল্প আকারে উপস্থাপন করা হয়। ২০১২ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ চীনা কোম্পানি সিসিসিসির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। দুই দেশের চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে টানেল নির্মাণসহ ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে শুরুতে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। ২০২৫ সালে তা বেড়ে প্রতিদিন চলাচল করবে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যান। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
প্রসঙ্গত, চীনের সাংহাই নগরীর আদলে চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারা উপজেলাকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’র আদলে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল।
এ টানেলের এক প্রান্তে রয়েছে আনোয়ারার ভারী শিল্প এলাকা। অন্য প্রান্তে চট্টগ্রাম নগরী, বিমান ও সমুদ্রবন্দর। এ টানেল শহর এবং গ্রামকে এক সুতায় যুক্ত করবে। বাংলাদেশ সরকার ও চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক এ প্রকল্পের যৌথ অর্থায়ন করেছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে।