নিজের পেশায় অনবদ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সমাজের সুবিধা বঞ্চিত পথশিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা অর্জনে অবদান রাখায় বিশ্বসেরা শিক্ষক-২০১৭ (গ্লোবাল টিচার প্রাইজ) পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শাহনাজ পারভিন। তিনি উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত এবং পৌরশহরের শান্তিনগরস্থ শেরপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।
লন্ডনভিত্তিক ভারকি ফাউন্ডেশন বিশ্বের ১৭৯টি দেশ থেকে বিশ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে থেকে ৫০ জনের তালিকা করেন। এই তালিকায় রয়েছে শাহনাজ পারভিনের নাম। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের জন্য শিক্ষক শাহনাজ পারভীনকে মনোনীত করা হয়। তার সঙ্গে ৩৭টি দেশের একজন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন।
সমাজে শিক্ষকের ভূমিকার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি দিতেই সংস্থাটির পক্ষ থেকে তৃতীয়বারের মত এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। আগামি বছরের ১৯ মার্চ দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। একইসঙ্গে বিজয়ীদের দেয়া হবে অর্থ পুরস্কার ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
শাহনাজ পারভীন ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার পান। উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ে। সে সব শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। স্কুলের পর আরো একটি স্কুল চালিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের বিনা বেতনে শিক্ষা প্রদান করেন শাহনাজ পারভীন।
২০১৩ সালে তিনি স্বল্প পরিসরে এই কাজটি শুরু করেন। স্বামীর সাহায্য নিয়ে ২০১৫ সালে বাড়ির পাশে অন্য একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেন কর্মজীবী শিশুদের জন্য 'শেরপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়'। প্রতিদিন বিকাল ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত চলে এই স্কুলের পাঠ দান কার্যক্রম। বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষার্থীরা সবাই কর্মজীবী। কেউ বাসার কাজের মেয়ে, কেউ দোকানের কর্মচারি। এসব শিক্ষার্থীর পোশাক, বই, খাতা-কলম সব কিছুই কিনে দেন তিনি। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থী বেশী হওয়ায় নিজ খরচে দুইজন শিক্ষকও নিয়োগ দিয়ে নিয়মিত বেতনভাতাও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের জন্য মনোনিত হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করে শাহনাজ পারভিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্বল করতে সবার দোয়া চাই। এই ৫০ জনের তালিকা থেকে বাছাই শেষে টপ টেন এবং চুড়ান্ত বিজয়ী নির্বাচন করা হবে।'
শাহনাজ পারভীন ১৯৭৬ সালে বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর উপজেলার দাঁড়িগাছা গ্রামে এক শিক্ষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মানিক উল্লাহ ও মাতা মিসেস নুরজাহান বেগম পেশায় শিক্ষক। মায়ের কর্মস্থল শেরপুর পৌরশহরের উলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন।
১৯৯২ সালে শেরপুর শহীদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আলিম পাশ করেন। এরপর বগুড়া সরকারী আযিযুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পর তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন। শাহনাজ পারভীনের সংসার জীবনে দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে মাসুমা মরিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। ছোট মেয়ে আমেনা মুমতারিন শ্রেয়া বগুড়া ক্যান্টঃপাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী মোহাম্মাদ আলী শেরপুর শহিদীয়া আলিয়া মাদ্রাসায় আরবী প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
বিডি প্রতিদিন/২৪ ডিসেম্বর ২০১৬/হিমেল