দুধের শিশু বেঁচে গেছে, কিন্তু মাটি চাপা পড়ে মারা গেছে বাবা-মা। অভিভাবক এখন বড় বোন যার বয়স ৬ বছর। আবার বাবা, মা, মেয়ে তিন জনই মারা গেছে বেঁচে আছে শুধু ছেলে। এমনই মর্মস্পর্শী অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিয়েছে রাঙামাটির পাহাড় ধস। ছয় বছরের এই ছোট্ট জীবনেই মিম বুঝে গেছে তার শৈশব আর কখনই রঙিন হবে না। হয়তো মেনেও নিয়েছে নিজের নিয়তি। বাবা, মামা দুজনেই হাড়িয়ে গেছে পাহাড়ের মাটিতে। কিন্তু রেখে গেছে বিরাট দায়িত্ব। ছোট বোন সুমাইয়ার বয়স মাত্র ১৭ মাস। এ দুনিয়ায় সে ছাড়া তার আর কেউ নেই। তার এই অপলক দৃষ্টি বোঝার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু এটুকু বুঝি যায়, এই নিস্তব্ধতা অভিশাপের চেয়েও ভয়ংকর।
তবে হতোভাগা শিশুটির আপতত ঠিকানা এখন আশ্রয় কেন্দ্র বলে জানালেন শিশুদের ফুফু রিনা আক্তার। তিনি বলেন, প্রায় সাত বছর ধরে রাঙামাটি বেতার কেন্দ্রের পাশে পাহাড়ের নিচে রূপ নগর নামক এলাকায় বসবাস করে আসছিল তো তার ভাই-ভাবি। সে বাড়িতে জন্ম সুমাইয়ার ও মিমের। গত ১২জুন রাতে টানা বৃষ্টির ভাড়ি বর্ষণে ভেঙ্গে পরে পাহাড়। পাহাড়ের ভয়ষ্কর রূপ দেখে তিনি আগে থেকে সড়িয়ে নিয়ে যায় ভাতিজি সুমাইয়ার ও মিমকে। তার একটুপর শুনতে পায় আবারও পাহাড় ভাঙ্গার শব্দ। পাহাড়ের মাটিতে বিলীন হয়ে যায় তার ভাই-ভাবিসহ ঘরবাড়ি। এখনো খুঁজে পায়নি তাদের মরদেহ। নিজ ঘরে হয়েছে তাদের কবর। অন্যদিকে উদ্ধার কাজও বন্ধ। তাই ভাই-ভাবির মরামুখও দেখার আশাও নেই তাদের। এখন শুধু একটা চিন্তা কোথায় রাখবে সুমাইয়া ও মিমকে। কি করে মানুষ করবে তাদের। কারণ তার নিজেরও মাথাগুজার ঠাই টুকুও নেই।
অন্যদিকে একই পরিণতি ফারিয়া আর রাকিবের। মা আগেই ছিল না। বাবাকেও কেড়ে নিয়েছে পাহাড়। অভিভাবক এখন চাচা আর দাদী। কিন্তু সব কিছু হাড়িয়ে তারাও দিশেহারা। বেচেঁ থাকারমত নেই আবাসস্থান। নেই পড়নের কাপড়, নেই টাকা। কি করে বড় করবে এ শিশুদের এ নিয়ে ভেঙ্গে পরেছে চাচা ও দাদির মনও। কিন্তু এর বাইরেও অভিশাপ পিছু ছাড়ে না।
পুরো আশ্রয় কেন্দ্র জুড়ে এমন অসংখ্য গল্প যার কোনটাই সহজ আর স্বাভাবিক নয়। কারো পরিবারের একজনও বেঁচে আছে। কারো পরিবারের দুইজন। আবার কারো কারো পরিবার এখনো নিখোঁজ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কেউ মাটিতে শুয়ে আছে। আবার কেউ বারান্দায়। পুরো আশ্রয় কেন্দ্রের চিত্র এখন বিষাদময়। কান্না জেনো থমছেনা স্বজনহারা পরিবারগুলোর। অন্যদিকে, রাঙামাটি হাসপাতালে পাহাড় ধসে আহতদের খোজ নিতে গিয়ে খবর মিললো আরেক এতিম শিশুর। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জিহাদ বেঁচে গেছে অলৌকিকভাবে। কিন্তু কিচ্ছু বাকি নেই আঁকড়ে ধরার মত। মা, বাবা, বোন কাউকেই ছাড়েনি নিষ্ঠুর পাহাড়। বাকরুদ্ধো জিহাদের চোখ এখনো খুঁজে বেড়েছে বাবা-মা আর ছোঠ বোনকে। কান্না জড়িত কন্ঠে জিহাদ নিজেই ঘটনার বর্ণনা দিল। পাহাড়ের মাটির নিচে প্রায় আড়াই ঘন্টা থাকার পর উদ্ধার করা হয় তাকে। পুরো শরীর ছিল মাটির নিচে। শুধু মাথাটা রক্ষাপায় তার। তাই আলোকিকভাবে বেঁচে যায় সে। তবে মাটিচাপা থাকার কারণে এখন সে আগেরমত হাঁটতে পারে না। আধও হাটতে পারবে কিনা সে জানে না। তার এখন আশ্রয় তার এক স্কুলের বন্ধুর বাড়ি। জানে না কতদিন সেখানে থাকবে। এখনো বাড়ছে আশ্রয় কেন্দ্র মানুষের সংখ্যা। থামছেনা বৃষ্টি। তাই আবারও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে পাহাড়।
জানা গেছে, রাঙামাটি ১৭টি আশ্রয় কেন্দ্র এখন আড়াই হাজারেরও অধিক মানুষের বসবাস। তবে নেই কাতা-বালিশ, নেই কম্বল, নেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খাবার। রাঙামাটি আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ঘুড়ে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। কিন্তু অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষও। রাঙামাটি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সেচ্ছাসেবকের কাজ করছে প্রিয় রাঙামাটি নামে এক যুবক সংগঠন।
রাঙামাটির পাহাড় ধসের পরিস্থিতি প্রায় প্রতিদিন আসছেন সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধি দল। শনিবার রাঙামাটি পাহাড় ধসের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদু। তিনি আবার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রীতদের সহায়তার আশ্বাসও দেন।
অন্যদিকে, রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় উদ্ধারকাজ আনুষ্ঠানিক সমাপ্ত ঘোষণা করার পর আরও দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার সকালে অজ্ঞাত মরদেহ দুটি উদ্ধার করা হয়। পাহাড়ধসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত রাঙামাটিতেই ১১৪ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তাই স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আবার রাঙামাটিতে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিস। শনিবার সকাল থেকে শহরের মুসলিমপাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকায় উদ্ধারকাজ শুরু হয়।
রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, পাহাড় ধসে নিহতদের মরদেহ পানিতে ভাসছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে তারা উদ্ধারকাজ শুরু করেন। তবে এখনো পর্যন্ত কোথাও কোনো মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে শহরের এ দুটি এলাকায় পাহাড় ধসে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে তারা কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার