মধ্যপ্রাচ্য এবং পারস্য উপসাগরের আশপাশে যখনই কোনো রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সমস্যা দেখা দেয় তখনই পশ্চিমা আদেশ তথা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই অঞ্চলের ওপর নানা ছুতোয় যুদ্ধ বাধায়। এসব যুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য তাদের সামরিক অর্জনগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া, যাতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। কোনো রকম উপায়ে অন্তর না পেয়ে অঞ্চলগুলো তাদের ‘ট্রাম কার্ড’ হরমুজ প্রণালিকে বেছে নেয়। এবারও তাই ঘটেছে, দীর্ঘদিন ধরে গাজার ওপর ইসরায়েলি হামলা শেষ পর্যন্ত ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে পরিণত হয়ে একটানা ১২ দিন গড়ায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এমনকি ইরানের তেল রপ্তানিতে আমেরিকা বাধা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলবাহী জাহাজগুলো নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে। প্রতিশোধস্বরূপ হরমুজ প্রণালি দিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপগামী তেলবাহী জাহাজ পারাপার বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেয় ইরান। আর এতেই হয়েছে কেল্লাফতে। আশির দশকেও ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় তারা পরস্পরের তেল রপ্তানি বন্ধ করতে চেয়েছিল।
যুদ্ধের কারণে সে সময় জ্বালানি তেল বহনকারী ২৪০টি তেলের ট্যাংকার আক্রান্ত হয়েছিল এবং ৫৫টি ডুবে গিয়েছিল। হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচলের জন্য দুটো লেন রয়েছে এবং প্রতিটি লেন দুই মাইল প্রশস্ত। প্রণালিটি সংকীর্ণ হলেও জ্বালানি তেল বহনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ চলাচলে এই প্রণালিটি যথেষ্ট গভীর এবং চওড়া। প্রতিদিন এই প্রণালি দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্দরে পৌঁছায় দুই কোটি ব্যারেল তেল এবং তার সমপরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে যত তেল এবং তরলীকৃত গ্যাস সরবরাহ হয়, তার এক-পঞ্চমাংশই যায় এই হরমুজ প্রণালি দিয়ে। উল্লেখ্য মালাক্কা প্রণালি দিয়ে জ্বালানি তেল রপ্তানি হয় ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল এবং সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন ৫৫ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়।
হরমুজ প্রণালি হচ্ছে ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রধান রুট। প্রণালিটি একটি সরু জলপথ, যা পশ্চিমের পারস্য উপসাগরকে আগে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে এবং আরব উপদ্বীপ থেকে ইরানকে পৃথক করেছে। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সামুদ্রিক পথটি আন্তর্জাতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বব্যাপী পেট্রোলিয়াম পরিবহনে প্রণালিটির কৌশলগত গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ খনিজ তেলবাহী জাহাজ যাতায়াতের এটিই একমাত্র পথ। জলপথটির সবচেয়ে সরু অংশের দৈর্ঘ্য ২১ মাইল এবং প্রস্থ দুই মাইল। মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মতে, ২০০৯ সালে সমুদ্রপথে বৈশ্বিক খনিজ তেল বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ হরমুজ প্রণালি দিয়ে সম্পাদিত হয়। প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত তেলের বেশির ভাগই এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। জাপানের আমদানিকৃত তেলের তিন-চতুর্থাংশ হরমুজের ওপর দিয়ে নিয়ে যায়। আর চীনের আমদানিকৃত তেলের অর্ধেকই আসে হরমুজ প্রণালি হয়ে। অর্থাৎ বিশ্বের শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথগুলোর একটি এই হরমুজ প্রণালি। জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার পর্যবেক্ষক সংস্থা ভোরটেক্সোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন এই জলপথ দিয়ে পরিবহন করা হয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ থেকে ২ কোটি ৮ লাখ পরিশোধিত-অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস। জ্বালানি তেল উত্তোলন ও বিপণনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের সদস্য রাষ্ট্র সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাক তাদের বেশির ভাগ তেল হরমুজ প্রণালি দিয়ে এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠায়। এই পথে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজ এবং তেল পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ পঞ্চম নৌবহর নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের ১২টিরও বেশি দেশে মার্কিন সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ওই অঞ্চলের জলসীমায়ও যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ মোতায়েন করা আছে। তা ছাড়া রয়েছে বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ। সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে কমপক্ষে ১৯টি স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা রয়েছে। এসব ঘাঁটিতে সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আছে। তাই যুদ্ধের কারণে আর যা-ই হোক, সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটিতে ২০২৩ সালে ১৩৭.০৫ বিলিয়ন এবং ২০২২ সালে ১৩৪.৫৫ বিলিয়ন গ্যালন পেট্রোল সরবরাহ হয়েছে এই হরমুজ প্রণালি দিয়ে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এই বাণিজ্যপথটি বন্ধের হুমকি দেয় ইরান। এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত মোট তেলের যে ২০ শতাংশ পরিবাহিত হয়, যার মূল্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। ইরানের হুমকির ফলে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭.৩৬ ডলার প্রতি ব্যারেল এবং ডব্লিউটিআই তেলের দাম বেড়েছে ৭৪.১৫ ডলার। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি তেলনির্ভর দেশ চীন, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হতো। অর্থাৎ ইরান যদি হরমুজ প্রণালি সত্যিই বন্ধ করে দিত, তাহলে বিশ্ববাজারে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ত। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ তেল সরবরাহ হয়, হঠাৎ করে তার এক-পঞ্চমাংশ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজুড়ে তেলের দাম অনেক বেড়ে যেত। বড় ক্ষতি হতো চীনের। কারণ ইরানের মোট উৎপাদিত তেলের ৯০ শতাংশই যায় চীনে। তাই ইরানের জন্যও এটি হতো একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। কারণ জ্বালানি তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইরানের তেলও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায় এই জলপথ ধরে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো বর্তমানের ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে দৃশ্যত ইরানের পাশে আছে। যদি হরমুজ প্রণালি ইরান বন্ধ করে দিত তাহলে নিজেদের স্বার্থেই তারা ইরানের বিপক্ষে যেত, এমন আশঙ্কাও ছিল ব্যাপক। মোট কথা হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে সারা বিশ্বে বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দা আরও ঘনীভূত হতো। যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়েছে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে তেলবাহী জাহাজ বন্ধ করে দিলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সমূহ বিপদ উপলব্ধি করে ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ এ যাত্রায় হরমুজ প্রণালিই যুদ্ধ বন্ধের নিয়ামক বা ট্রাম্প কার্ড হিসেবে আবির্ভূত হলো।
লেখক : অধ্যাপক আইআইটি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়