কোরআন সংক্ষিপ্ত এবং সারনির্যাসধর্মী গ্রন্থ। যেখানে নামাজ, রোজার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানের বিবরণও অতি সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে। সেই কোরআনে ইবরাহিম (আ.)-এর আলোচনা বিভিন্ন সুরায় এত বেশি করা হয়েছে যে সব আলোচনা একত্র করলে প্রায় এক পারার সমান হবে। শুধু তা-ই নয়, কোরআনের পূর্ণ একটি সুরাই নাজিল হয়েছে ইবরাহিম (আ.)-এর নামে। এতেই বোঝা যায়, ইবরাহিম (আ.)-এর জীবন, আদর্শ, দর্শন ও কর্ম আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমাদের পরম আপনজন। তিনি এই উম্মতের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর সম্পর্কে মহান আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের দীন। তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম (হজ ৭৮)। ইবরাহিম (আ.) হজের ঘোষক ছিলেন। কাবাঘর নির্মাণকাজ শেষ হলে আল্লাহ তাঁকে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে হজের ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন, আর মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে (হজ ২৭)।
এটা সেই সময়ের কথা, যখন রেডিও-টেলিভিশন-ইন্টারনেট ছিল না। যার সহযোগিতা নিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে হজের ঘোষণা দেবেন। আবার মক্কায় তখন লোকবসতিও তেমন ছিল না, যাদের সামনে তিনি বক্তব্য দেবেন। আল্লাহর প্রতি ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে তিনি কোনো প্রশ্ন তোলেননি। বরং জনমানবশূন্য মক্কার পাহাড়ে উঠে তিনি হজের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহর কী অপার মহিমা, সেই ঘোষণা ঠিকই পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে এখন প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ হজ করতে মক্কায় যায়। এটি ইবরাহিম (আ.)-এর একটি বিশেষ মর্যাদা।
ইবরাহিম (আ.)-এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- তার পর থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যত নবী-রসুল পৃথিবীতে এসেছেন, সবাই এসেছেন ইবরাহিম (আ.)-এর বংশ থেকে।
কোরআনে আল্লাহ পঁচিশজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁদের ভিতর থেকে পাঁচজনকে আল্লাহ ‘দৃঢ়প্রত্যয়ী রসুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন, ইবরাহিম (আ.) ছিলেন সেই পাঁচজনের একজন। ইবরাহিম (আ.)-এর এক সন্তান ছিলেন ইসহাক (আ.)। তাঁর আরেক নাম ইসরায়েল। ইসহাকের বংশধারাকে বনি ইসরাইল বলা হয়। এই বংশ থেকে অসংখ্য নবী-রসুল এসেছেন।
ইবরাহিম (আ.)-এর পুরো জীবনই ছিল পরীক্ষাময়। এবং সব পরীক্ষায় তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি যে সমাজে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই সমাজ ছিল মূর্তিপূজার সমাজ। এমনকি তাঁর পিতাও মূর্তিপূজার শিরকে জড়িত ছিলেন। এমন একটি সমাজে যখন কোনো শিশু জন্ম নেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মূর্তির প্রতি দুর্বলতা তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) শৈশব থেকেই একত্ববাদের চেতনায় বিশ্বাসী হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। আবার মূর্তিপূজা তথা শিরকের বিরোধিতা করায় ইবরাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করে তারা। এতেও তিনি বিচলিত হননি। আল্লাহ তাঁর প্রিয় খলিলকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, হে আগুন, ইবরাহিমের জন্য ঠান্ডা ও প্রশান্তিময় হয়ে যাও (আম্বিয়া ৬৯)।
দুধের শিশু ইসমাইল ও স্ত্রী হাজেরাকে জনমানবশূন্য মক্কায় রেখে আসা ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের আরেকটি পরীক্ষা। সেই সময় মক্কা ছিল জনমানবহীন অনাবাদি পাথুরে ভূমি। সেখানে পানিরও কোনো উৎস ছিল না। সেরকম একটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে আসেন ইবরাহিম (আ.)। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো আপত্তি বা প্রশ্ন তোলেননি। বরং বিনা প্রশ্নে আল্লাহর আদেশ পালন করেছেন। স্ত্রী হাজেরাও আল্লাহর এই নির্দেশ মাথা পেতে বরণ করেছেন। জনমানবহীন অনাবাদি সেই ভূমিতে মা-সন্তানের অসিলায় একপর্যায়ে আল্লাহর কুদরতে জমজম কুয়া তৈরি হয় এবং সেই কুয়াকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। আজকের লোকসমাগমপূর্ণ মক্কানগরী, ইবরাহিম-পরিবারের সে দিনের ত্যাগের ফসল।
সন্তানকে কোরবানি করা ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটি। ইবরাহিম (আ.) দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে, যখন সন্তান হওয়ার কোনো আশাই অবশিষ্ট থাকে না, তখন তিনি ইসমাইলকে লাভ করেন। এই সন্তান যখন হাঁটাচলা করার বয়সে উপনীত হয়, অর্থাৎ যে বয়সে সন্তানের প্রতি বাবার আকর্ষণ ও ভালোবাসা সবচেয়ে তীব্র হয়, তখন আল্লাহ ইসমাইলকে কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। এমন অস্বাভাবিক নির্দেশ পেলে আমরা হয়তো বেঁকে বসতাম, নানা আপত্তি তুলতাম। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) বেঁকে বসেননি, আপত্তিও তোলেননি। বরং সন্তানের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন। পিতার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, হে আমার পিতা, আপনি আপনার স্বপ্নের আদেশ পালন করুন। নিশ্চয় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। ইসমাইল (আ.)-এর এই যুগান্তকারী জবাবের ভিতর পৃথিবীর সব তরুণ-যুবকের জন্য বিশাল বড় শিক্ষা রয়েছে। ইবরাহিম (আ.)-এর পুরো জীবনই আমাদের জন্য শিক্ষা। জীবনের নানা দুর্বিপাক, ঘাতপ্রতিঘাত এবং দুঃখকষ্টে নিপতিত হলে আমরা তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারি।
জুমার বয়ান থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ