আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি চলছে। ঘোষিত টাইমফ্রেমের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোট করতে প্রস্তুত। সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনসংযোগ করছেন। তা সত্ত্বেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। এনসিপি সংবিধান পরিবর্তন ও সংস্কারের আগে নির্বাচন চায় না। দলীয়প্রধান তরুণ নেতা নাহিদ ইসলাম বিদেশে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে মনে হয় নির্বাচন হবে না। এটা হলো নির্বাচন প্রশ্নে এনসিপির অবস্থানের সফট ভাষ্য। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কথা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। তার মানে হতে দেওয়া হবে না।। দলটি সংসদ নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায়। গণপরিষদ নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে তারপর নির্বাচন। গণপরিষদ নির্বাচন কোন আইনের ভিত্তিতে হবে, সেটা অবশ্য তারা বলছেন না। বিদ্যমান সংবিধানে গণপরিষদ নির্বাচনের কোনো বিধান নেই। বর্তমানে সংশোধিত আকারে ১৯৭২ সালের সংবিধান বলবৎ রয়েছে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কীভাবে গণপরিষদ নির্বাচন করা হবে? বর্তমান সংবিধান স্থগিত করে ১৯৭০ সালের মতো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে গণপরিষদ নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু বহাল সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ধরনের কোনো আদেশ জারি করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
পিআর পদ্ধতির ক্ষেত্রেও একই কথা। কাজেই জাতীয় সংসদ গঠন এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক বিধিসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত গণপরিষদ বা পিআর পদ্ধতি অনুসরণের দাবি অযৌক্তিক ও অবাস্তব। এগুলো বোঝার জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যারা পিআর ও গণপরিষদ চাইছেন তারাও যে বিষয়টি বোঝেন না, তা-তো নয়। হয়তো জেনেবুঝেই তারা দাবিগুলো করছেন, যাতে সাধারণ নির্বাচন আটকে দেওয়া যায়। নির্বাচন না হলে বা বিলম্বিত হলেই বা তাদের কী লাভ? লাভক্ষতির অঙ্ক হয়তো তারা কষেও রেখেছেন, যা আমরা জানি না। এর সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্কের যোগসূত্র থাকা বিচিত্র নয়।
১৯৭১ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নবতর মূল্যায়ন ও ততোধিক নতুন উপসংহার রচনার চিন্তাভাবনাও কোনো কোনো মহলের থাকতে পারে। সমমর্যাদার ভিত্তিতে সব দেশের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার যে বৈদেশিক নীতি বাংলাদেশ মেনে চলেছে, সেটা হয়তো তাদের পছন্দ নয়। তারা বাংলাদেশে একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য কাজ করছে না, তা-ও বলা যায় না। পানি ঘোলা করতে যুক্তির প্রয়োজন হয় না। ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্ক অহিনকুল। পক্ষান্তরে ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী। বড় মানচিত্রের দেশ হিসেবে ইন্ডিয়া আমাদের ওপর খবরদারি করতে চায়। নিজের স্বার্থ ষোলো আনা আর বাংলাদেশের মাথায় হাত বুলিয়ে খুশি রাখা। বৃহৎ এই প্রতিবেশীর এ ধরনের স্বার্থপর নীতি আওয়ামী লীগের কাছে খারাপ না লাগলেও জনগণের এক বিরাট অংশ এমনটি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা এই স্বার্থপর প্রতিবেশীর প্রতি বিরক্ত ক্ষেত্র বিশেষে বিদ্বিষ্ট। ভারতকে তারা ভালো ও নিরাপদ মিত্র মনে করেন না। কিন্তু দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক যুদ্ধংদেহী নয়। কিন্তু এখনো যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষে পাকিস্তানের হয়ে অস্ত্র ধারণ করেছিল এবং এখনো সেই আদর্শের ছায়াতলে যারা রয়েছে তারা পাকিস্তানের চশমা পরে হয়তো ইতিহাসের নতুন পাঠ লিখতে চাইছে। তারা একাত্তরের প্রশ্নটিকে দুই ভাইয়ের মধ্যকার ভুলবোঝাবুঝির অবসানের মতো সমাধান চাইছে। দূরদেশে বসে অশালীন গালিগালাজে চ্যাম্পিয়ন একজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট যখন বলেন মুক্তিযুদ্ধে ২ হাজার মানুষ মারা গেছে, তখন এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে এটা এক ফজুল লোকের চটুল কথা মাত্র।
নির্বাচন না চাওয়ার পেছনে অনেক কারণই থাকতে পারে। কারণ যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, দেশের জন্য এটা মঙ্গলজনক হবে না। দেশ ও জনগণের ভালো চাইলে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। কোনো কারণে নির্বাচনের ট্রেন আটকে গেলে দেশ জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে, যার ধকল সামলানো কঠিন। যারা নির্বাচন চাইছেন না বা নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে অন্য কোনো মতলব হাসিল করতে চান, আখেরে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একুল-ওকুল দুকুলই হারাবেন। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ যথার্থই বলেছেন, তারা রাজনীতি থেকে মাইনাস হয়ে যাবেন।
আশার কথা এই যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকার ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল বলেই প্রতীয়মান হয়। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার আগপর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান পরিষ্কার ছিল না। যৌথ ঘোষণার পরও দোদুল্যমানতা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো সুশীল বলছিলেন যে সরকারের ভিতরে আরও একটি সরকার রয়েছে। ভিতরের সেই সরকার সম্ভবত ড. ইউনূসের কাঁধে বন্দুক রেখে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছিল। তারা বলতে চাইছিল যে এই সরকারই জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। গণ অভ্যুত্থানকে তারা নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিল। তারা অন্তত পাঁচ বছর এই সরকার থাকার তত্ত্ব প্রচার করছিল। দুয়েকজন উপদেষ্টাও অনুরূপ কথা বলতে শুরু করেছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার এতে সায় ছিল কি না, সেটা বলা মুশকিল। তবে নতুন বাস্তবতা এই যে সরকারের ভিতরে কোনো সরকার থেকে থাকলেও তাদের শক্তি এখন বোধ হয় কমে এসেছে। সম্ভবত দুর্বল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক।
জেন্টলম্যান ড. ইউনূস উদ্যমী, আশাবাদী এবং বিশ্ববরেণ্য একজন জ্ঞানী মানুষ। তিনি বিপ্লবী নন। আধাখেঁচড়া বিপ্লবী এবং হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে ওঠা কিছু মানুষ হয়তো ভেবেছিল বিশ্ববরেণ্য নোবেল লরিয়েটকে সামনে রেখে মবোটিক ওয়েতে একটা বিপ্লব তারা এই সুযোগ করেই ফেলবে। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন এই ঝুঁকি নেবেন! এই বাস্তবতা ‘বিপ্লবী’দের হতাশ করতেই পারে।
নির্বাচন কমিশনের অবস্থানও বিপ্লবীদের পার্টির পছন্দ নয়। তারা নতুন ইসি চায়। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ফেয়ার নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। যদি কেউ, কোনো মহল যেনতেন নির্বাচনের চিন্তা করে থাকে, তাদের উদ্দেশেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ২৩ আগস্ট রাজশাহীতে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার একপর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন থাকবে, সে সম্পর্কে বলেন, তারা ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। এবার ফাঁদ দেখবে ইনশাআল্লাহ। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরদার অভিযান চলবে। যারা কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে জেতার চিন্তা করছে, তারা সেটা পারবে না। সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে থাকবে। অতীতে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকত। কিন্তু স্ট্রাইক করতে দেখা যায়নি। এবার সেটা হবে না। সরকার কোনো বেআইনি চাপ দিলে আপনারা আমাকে আর এই পদে দেখবেন না।
ওই সভায় সিইসি যে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছেন বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটলে নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হতে পারার কথা নয়। সেনাবাহিনী যদি সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকে তাহলে আশা করা যায়, ভোটে পেশিশক্তির ব্যবহার অসম্ভব হয়ে পড়বে। তবে শুধু নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে হবে না। ভোটার তালিকায় কোনো গলদও রাখা যাবে না। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আপত্তির সময় খুব কম দেওয়া হয়েছে। এটা বাড়াতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে প্রার্থী হতে কিংবা জনসংযোগ করতে কোনো পক্ষ যাতে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তারও নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ নয়, এমন প্রার্থীদের মাঠেই নামতে দেওয়া হয়নি। ঠ্যাঙানো হয়েছে। অনেককে মনোনয়নপত্র জমা দিতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দেওয়া হয়নি। সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তা-ও দেখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে প্রতিবেশী ভারতের সাবেক সিইসি টিএন সেশনের কথা। টিএন সেশনকে ভারতের সেই সময়ের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের ত্রাণকর্তা বলা হয়ে থাকে। তিনি ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা এমনকি মন্ত্রী-মিনিস্টারদেরও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে কত ধানে কত চাল। বিষয় যখন নির্বাচন তখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের হাত কতটা লম্বা তা-ও দেখিয়ে দিয়েছিলেন লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচনে। ভোটের প্রচারণায় সরকারি গাড়ি ব্যবহার করায় বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর গাড়ি ইসি বাজেয়াপ্ত করেছিল। কে মন্ত্রী আর কে সাধারণ নাগরিক সেটা নির্বাচন কমিশনের দেখার বিষয় না। আইনের চোখে সবাই সমান। সেশন বাস্তবে সেটা প্রমাণও করেছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত কেবিনেট সেক্রেটারি টিএন সেশন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল মেয়াদে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন।
সেশনের প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করলাম এই কথাটি বলার জন্য যে সিইসি ও ইসি চাইলে নির্বাচনে কারও পক্ষেই অনিয়ম করা সম্ভব নয়। কেননা এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির হাত নির্বাচন পিরিয়ডে অনেক লম্বা। কিন্তু আমাদের দেশে অতীতে বারবার দেখেছি সিইসি ও ইসি সরকারের ভয়ে নিজের লম্বা ও শক্তিশালী হাতটি গুটিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করেছে। সেটাকেই তারা নিরাপদ মনে করেছে। তবে এখন আশা করতে পারি যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন তার বৈধ ক্ষমতা প্রয়োগে শৈথিল্য প্রদর্শন করবে না। আর সেটা না করলে নির্বাচন সর্বতোভাবে ফ্রি ও ফেয়ার হতে বাধ্য । নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এবং মানুষ নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে যোগ্য প্রার্থীদের বেছে নিতে কখনোই ভুল করবে না। প্রার্থী খারাপ ভালো যেমনই হোক শুধু মার্কা দেখে ভোট দেবে, সে আশা করা যায় না।
আসনভিত্তিক নির্বাচনে একালে মার্কার হুজুগে ভোট আদায় সম্ভব নয়। এত দিনে রাজনীতির কায়কারবার দেখে ও শুনে জনগণ সচেতন হয়ে গেছে। বিশেষ করে আসনভিত্তিক এমপি ইলেকশনে প্রার্থীরা ভোটারসাধারণের অপরিচিত নন। কে যোগ্য, কে গডফাদার, কে গুন্ডা-চাঁদাবাজ পালন করেন, কাজে ও কথায় কে কতটা সাধু- তা জেনে নেওয়া কঠিনও নয়। কাজেই এবারের নির্বাচন বড় দলের জন্যও সহজ হবে না। এমতাবস্থায় প্রার্থী বাছাইয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বৃহৎ দল বিএনপির সামনে অগ্নিপরীক্ষা। দল বড়, মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যাও বেশি। জামায়াতের এ সমস্যা বোধ হয় তুলনামূলকভাবে কম। দলটি পিআর ও বিলম্বিত নির্বাচনের কথা বললেও নির্বাচন প্রচারণা শুরু করেছে আগেভাগেই। প্রার্থীও বাছাই করে রেখেছে। পক্ষান্তরে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানান কর্মসূচি পালন করে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। দলের উচ্চপর্যায়ে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও হয়তো চলমান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাবধানি না হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এনসিপি নির্বাচনে আসবে কি না, এখনই তা বলা কঠিন। না এলে এই নবীন দলটির ছিটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একবার ট্রেন মিস করলে পরের ট্রেনের অপেক্ষা করা, সে-ও কিন্তু সহজ নয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক