নবীজি (সা.)-এর বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, পৃথিবী যত পরিণতির দিকে এগোবে এবং কেয়ামত যত নিকটবর্তী হবে, নানামুখী ফিতনা ততই বৃদ্ধি পাবে। সেই ফিতনার সয়লাবের ভিতর মানুষের জন্য ইমান ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে। সেই ফিতনা হবে বৃষ্টির ফোঁটার মতো সীমাহীন, অন্ধকার রাতের মতো গহিন। এক ফিতনা থেকে বাঁচলে নতুন আরেক ফিতনা মানুষকে পর্যুদস্ত করবে। তাই ইমান সুরক্ষার স্বার্থেই কেয়ামত-পূর্ব সর্বগ্রাসী ফিতনা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
শেষ জমানার ফিতনা সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, অন্ধকার রাতের মতো ফিতনার আগমনের আগেই তোমরা সৎকাজের প্রতি অগ্রসর হও। ওই সময় যে ব্যক্তি সকালে মুমিন থাকবে সে সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যাবে এবং যে সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে সে সকালে কাফের হয়ে যাবে। মানুষ দুনিয়ার সামান্য স্বার্থে তার দীন বিক্রি করে দেবে (মুসলিম)। রসুল (সা.) আরও বলেছেন, তোমাদের পর এমন যুগ আসবে, যখন (দীনের ওপর) সবর করে থাকা জ্বলন্ত অঙ্গার হাতের মুঠোয় ধারণ করে রাখার মতো (যন্ত্রণাদায়ক) হবে। ওই সময় দীনের ওপর আমলকারীর প্রতিদান হবে তোমাদের মতো পঞ্চাশজন আমলকারীর প্রতিদানের সমান (তিরমিজি)।
এই হাদিসের মাধ্যমে কেয়ামত-পূর্ব সময়ের ভয়াবহতা খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আর এ কারণেই, ভয়াবহ এই সময়ে ইমানের ওপর যারা অবিচল থাকবে তাদের জন্য রসুল (সা.) অভাবনীয় পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফিতনাসংকুল সেই ভয়ংকর যুগে আমরা ইতোমধ্যে প্রবেশ করে ফেলেছি। আমাদের পরিবারে, অফিসে, রাস্তায়, এমনকি আমাদের মোবাইল ফোনে, সবখানে ফিতনার হাতছানি। অবিরাম বৃষ্টির মতো পড়তে থাকা এই ফিতনায় আমাদের ইমান ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তারপরও আমরা ততটা সতর্ক হচ্ছি না, যতটা সতর্ক হওয়া দরকার। অথচ সাহাবাগণ রসুলের মুখে ফিতনার হাদিস শোনার পর নিজেদের ইমানের ব্যাপারে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
বর্তমানে ফিতনা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, অমুসলিম দেশ তো বটেই, মুসলিমপ্রধান দেশেও ইমান নিয়ে চলাটা কঠিন হয়ে গেছে। ইমানের ব্যাপারে যারা সোচ্চার, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পথে চলতে যারা আপোসহীন, তাদের পথেঘাটে সবখানে শুনতে হয়- আজকাল এত বাছবিচার করে চলা যায় না। এই মানুষগুলোকে সেকেলে, অসামাজিক, গোঁড়া, আনস্মার্ট ইত্যাদি নানা নেতিবাচক শব্দে পরিচিত করা হয়। কেউ যদি হারাম উপার্জনের পেশায় যুক্ত হতে না চায়, অনেক মা-বাবা পর্যন্ত তাকে ভর্ৎসনা করে। দাড়ি রাখতে গেলেও পরিবার ও সমাজ থেকে নানা কটুকথা শুনতে হয়। সমাজের এসব নেতিবাচক ও কটুকথায় অনেক মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে স্রোতের তালে গা ভাসিয়ে দেয়। ভাবে, এ যুগে আসলেই সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে নাজিল হওয়া ইসলাম পুরোপুরি পালন করা সম্ভব না। এসবই সমাজে ছড়িয়ে পড়া নানামুখী ফিতনার নমুনা।
দীন পালনের এই প্রতিবন্ধকতা এবং দীন পালনকারীদের সংখ্যালঘুত্ব দেখে রসুল (সা.)-এর একটি হাদিস মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, ইসলামের সূচনা হয়েছিল অপরিচিত অবস্থায়, এবং পুনরায় সে অপরিচিত অবস্থায় ফিরে যাবে, যেমনভাবে শুরু হয়েছিল। সুতরাং অপরিচিতদের জন্য সুসংবাদ (মুসলিম)।
মক্কায় ইসলামের যখন যাত্রা শুরু হয়, ইসলাম ছিল অপরিচিত। শুরুতে খুব কমসংখ্যক মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল। দিনে দিনে ইসলামের জৌলুশ, ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পায়। কেয়ামতের আগে ইসলাম আবার তার পূর্বের জায়গায় ফিরে যাবে। অর্থাৎ কেয়ামত-পূর্ব ফিতনার সময়ে মানুষ ইসলাম পালনকে বোঝা মনে করবে। ইসলাম পালনকারীরা সমাজের সবখানে কোণঠাসা হয়ে থাকবে। আর এই সময়ে যারা ইসলামের ওপর অবিচল থাকবে, তাদের জন্য রসুল (সা.) সুসংবাদ দিয়েছেন। ফিতনা কী? ফিতনা এক ধরনের ধোঁয়াশা। মরীচীকা। যা আমাদের ধোঁকার ভিতর ফেলে দেয়। যার বাহ্যিক চেহারা এক রকম, প্রকৃত চেহারা আরেক রকম। এসবই ফিতনা। মহান আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, আর জেনে রাখ- তোমাদের সম্পদ ও সন্তানসন্ততি নিঃসন্দেহে ফিতনা (পরীক্ষা) (আনফাল ২৮)। ধনসম্পদ আমাদের জন্য ফিতনা বা পরীক্ষা, এটা মোটামুটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু সন্তান কীভাবে ফিতনা হতে পারে, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। মূলত সন্তানের সুখের জন্য অনেক বাবা-মা হালাল-হারামের তোয়াক্কা করেন না। হারাম উপার্জন থেকে শুরু করে এমন অনেক কাজে জড়িয়ে পড়েন, যা ইমান পরিপন্থি। কখনো এমন হয়- বাবা-মায়ের অবহেলায় সন্তান দীনবিমুখ ভোগবাদী মানুষে পরিণত হয়। তখন এর পরোক্ষ দায় বাবা-মার ঘাড়ে পতিত হয়। এটা এক রকম ফিতনা। কেয়ামত-পূর্ব ফিতনা থেকে ইমান রক্ষা করতে কোরআন হাদিস অধ্যয়ন ও সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
জুমার মিম্বর থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ