শূন্য থেকে সহস্র- এ যাত্রাপথে মোশাররফ করিম নিজেই যেন এক বিশ্ববিদ্যালয়। দেখতে নায়কসুলভ নন, অথচ নায়কদের জনপ্রিয়তার সীমানা তিনি অনেক আগেই পেরিয়ে গেছেন। অভিনয় যখন জীবনের প্রতিচ্ছবি, তখন তিনি যেন সেই আয়নার মানুষ। বাংলাদেশের হাতেগোনা যে কজন অভিনেতা দেশের বাইরেও সমানভাবে জনপ্রিয়, তাদের প্রথম নামটাই মোশাররফ করিম। এ সময়ের শীর্ষ অভিনেতা।
শুরুটা ‘ক্যারাম’ দিয়ে
তার এই কিংবদন্তি পথচলার সূচনা হয়েছিল একটি নাটক দিয়ে, নাম ক্যারাম। গল্পের ভাবনা কচি খন্দকারের, রূপান্তর, চিত্রনাট্য আর নির্মাণে ছিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন তখনকার তরুণ মুখ- মারজুক রাসেল, আশুতোষ সুজন, শরাফ আহমেদ জীবন, রেদওয়ান রনি, ইফতেখার আহমেদ ফাহমি, আশফাক নিপুণ, আদনান আল রাজীব। তখন তারা নবীন, আজ সবাই পরিচিত নাম।
ক্যারেক্টররা হয়ে গেল আইকন
‘ক্যারাম’-এর গল্প ছিল সহজ, অথচ গভীর, ক্যারাম খেলায় বারবার হেরে যাওয়া এক সাধারণ মানুষের জীবনের হাসি-কান্নার গল্প। কিন্তু এই সরল গল্পকেই দর্শক গ্রহণ করেছিল নতুন এক ধাঁচে। শফিকুল, বিউটি, ঘেঁটি ব্যাকা মজিদ, তপন, সন্টু মামা- প্রত্যেক চরিত্রই হয়ে উঠেছিল একেকটা আইকন। নাটকটি যেন দর্শকদের সামনে জীবনের বাস্তব কোটে খেলা এক ক্যারাম ম্যাচই ছিল।
থাইল্যান্ড নয়, কুমিল্লা!
এই নাটকেই ছিল মোশাররফ করিমের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়। তিনি নিজেই স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘তখন আমার থাইল্যান্ডে একটি ধারাবাহিক নাটকে কাজ করার কথা ছিল। সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ঠিক সেই সময় ফোন আসে ক্যারাম নাটকের জন্য। শুনে জানলাম, গল্প কচি খন্দকারের, নির্মাতা ফারুকী ভাই। দ্বিধায় পড়ে যাই, থাইল্যান্ড না কুমিল্লা! শেষে স্ত্রী উৎসাহ দিল কুমিল্লায় যেতে। তারপর? তারপর তো সব ইতিহাস।’
‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান’
ঈদের দিন দুপুরে প্রচারিত হয়েছিল নাটকটি। বিকালে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য মুহূর্ত, রিকশায় করে শান্তিনগর দিয়ে যাচ্ছিলেন মোশাররফ করিম। এক দর্শক হঠাৎ সামনে এসে বলেন, ‘আপনি এত দিন কোথায় ছিলেন ভাই?’ সেদিনই তিনি বুঝে যান, তার অভিনয় দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। নাটকটির সংলাপ ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান’- বাংলা নাটকের ইতিহাসে আজও অন্যতম জনপ্রিয় ডায়ালগ। কেবল সংলাপ নয়, এই নাটকের সঙ্গে জড়িত সবার ক্যারিয়ারও সত্যিই গতিশীল হয়েছিল পরবর্তীতে।
ফারুকীর ঝুঁকিই ইতিহাস হয়ে গেল
তখনো ফারুকী ছিলেন তরুণ নির্মাতা, কিন্তু তার ছিল অদ্ভুত এক দূরদৃষ্টি। সেদিন তিনি বিশ্বাস করেছিলেন এক অনালোচিত অভিনেতার প্রতিভায়, আর সেই বিশ্বাসই তৈরি করে দেয় এক নতুন অধ্যায়, বাংলা নাটকের ইতিহাসে ‘মোশাররফ করিম অধ্যায়’।
ক্যারামের পর ক্যারাম...
হেফাজ ভাই থেকে ক্যারাম, ক্যারাম টু, তারপর হাউজফুল, ভাগ্যলিপি, জীবন চরিত, সিক্সটি নাইন- এরপর নানামাত্রিক চরিত্রের চলচ্চিত্রে অভিনয়। প্রতিটি কাজেই মোশাররফ করিম (সবার প্রিয় শামীম স্যার) নিজেকে নতুনভাবে প্রমাণ করেছেন। ‘ক্যারাম’-এর সেই সংলাপের মতোই, তার অভিনয় জীবনও গতিশীল থেকেছে প্রতিটি পদক্ষেপে। একটি নাটক, একটি সিদ্ধান্ত, আর এক অভিনেতার আত্মবিশ্বাস- এই তিনে মিলে রচিত হয়েছিল অভিনয়ের এক অনন্য ইতিহাস। হয়তো ক্যারাম খেলায় তিনি বারবার হেরেছিলেন, কিন্তু জীবনের খেলায় জিতে গেছেন একবারেই; একদম চিরস্থায়ীভাবে।