জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। ১৩ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল এ দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গতকাল বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমেই সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। পরে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেনের উপস্থাপিত যুক্তির কয়েকটি বিষয়ে জবাব দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল ও চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের জবাব দেন আইনজীবী আমির হোসেন। এর পরই এ মামলার বিচার সমাপ্ত ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘এ মামলায় রায়ের দিন আমরা ১৩ নভেম্বর জানাব। তবে সেটা হবে খুব কাছাকাছি সময়ে।’ এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম, ফারুক আহাম্মদ, বি এম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শুরুতেই পবিত্র কোরআনের সুরা নিসাসহ দুটি সুরার আয়াতের রেফারেন্স টেনে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, ‘আজ আমি ন্যায়বিচার প্রত্যক্ষ ও সাক্ষী হতে এসেছি। এ মামলায় সব ধরনের দালিলিক-মৌখিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ। তবে আসামিরা কোনো নির্দেশ দেননি বলে যুক্তি দেখিয়েছেন স্টেট ডিফেন্স। ভাগ্যিস বলেননি এ দেশে কোনো জুলাই রেভল্যুশন হয়নি, কেউ মারা যাননি কিংবা আহত হননি। অথচ বাংলাদেশে ১ হাজার ৪০০ মানুষ মারা গেলেন। এত বড় একটা জুলাই রেভল্যুশন হলো। হত্যাকাণ্ড হলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে।’
একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘বিচার যত কঠিনই হোক, যত বাধার প্রাচীর আসুক, সব বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয় তাহলে আমরা জাতি হিসেবে আগামী দিন এগোতে পারব না। আমি একটা বিচারের মানদণ্ড তুলে ধরতে চাই। ১৯৫১ সালে মাত্র এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করেছিলেন আমেরিকান আদালত। সেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও ইথেল রোজেনবার্গ। এ দম্পতির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ছিল।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়ায় আমেরিকার সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব জেগে উঠেছিল। সব নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। খালাস দিতে বলেছিলেন। এ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার অবস্থায় গিয়েছিল। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাঁদেরও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দুজন মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। আমরাও মনে করি নিশ্চয়ই এই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করা, মৃত্যুদণ্ড হওয়া, কার্যকর হওয়া যুক্তিসংগত।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘ন্যায়বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য-অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে। পাঁচ বছরের শিশু মারা যাবে। ১০ বছরের আনাস মারা যাবে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা যাবে। বুক চিতিয়ে আবার রাজপথে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদরা মারা যাবেন।
আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি বা এ দুজনের বিচার ব্যাহত হয় অথবা শাস্তি না হয় যেটা আইনে প্রেসক্রাইব করা আছে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সে কারণেই আমরা মনে করি এ বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি সেটা বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট (এ নিয়ে কোনো যুক্তিসংগত সন্দেহ নেই)।’
আসামিদের প্রতি আকাঙ্ক্ষা রেখে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি প্রত্যাশা করি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হলে এই আসামিরা বলবেন যেমন বলেছিলেন জুলিয়াস নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে। তিনি গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও অন্য যেসব জিনিস জীবনকে সত্যিই সুন্দর-সার্থক করে তোলে তা পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়। তারা হয়তো এমন একটি উক্তি দিয়েই এ বিচারের রায় মেনে নেবেন।
অন্য কোনো পথ বেছে নেবেন না। অন্য কোনো পথে তারা হাঁটবেন না। যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য ভূমি গড়ে তোলা যায়।’ সবশেষ ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেন দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা।
পরে ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং এ আইন নিয়ে তাদের যে যুক্তি সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বলার চেষ্টা করেছি, আমরা এখানে যেসব এভিডেন্স উপস্থাপন করেছি তা হিমালয়ের মতো দৃঢ়। ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ। এসব এভিডেন্স দুনিয়ার যে কোনো আদালতে যদি তুলে ধরা হয়, তাহলে এই অপরাধীদের অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লাইভ উইটনেস, ডিজিটাল এভিডেন্স এনেছি। যারা এ এভিডেন্সগুলো জেনারেট করেন, যেখানে তিনি কথাগুলো বলেছেন, সেসব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থাপন করেছি। যাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালত ১৩ নভেম্বর তারিখ নির্ধারণ করেছেন। ওই দিন ঘোষণা করা হবে কবে রায়।’
শেখ হাসিনা ও কামালের সঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও এ মামলার আসামি। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এর আগে ১৬ অক্টোবর টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে প্রসিকিউশন। ওই দিন হাসিনা-কামালের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। এরপর টানা তিন দিনে গত বুধবার নিজের দুই আসামির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের খালাস চান তিনি।
ওই দিনই মামলার অন্যতম আসামি ও রাজসাক্ষী চৌধুরী মামুনের খালাস চেয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন তাঁর আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। এ মামলায় প্রসিকিউশন থেকে ৫৪ জন সাক্ষী উপস্থাপন করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়াও দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্য দিয়েছেন এ মামলায়। তবে মামলার মূল দুই আসামি পলাতক থাকায় কোনো সাফাই সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ পাননি তারা। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।
এরপর ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। পরে সম্পূরক তালিকা দিয়ে আরও তিনজনকে সাক্ষী হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে।