যখন বিশ্বের নানা দেশে তরুণ প্রজন্ম নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলনে সক্রিয়, তখন ভারতের তরুণেরা তুলনামূলকভাবে নীরব। দেশটিতে ২৫ বছরের নিচে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩৭ কোটি—অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। রাজনীতি, দুর্নীতি ও বৈষম্য সম্পর্কে তারা অবহিত থাকলেও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করাকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ও অকার্যকর বলে মনে করেন। ‘দেশবিরোধী’ তকমা পাওয়ার আশঙ্কা, জাতিগত ও ভাষাগত বিভাজন, বেকারত্ব এবং অনিশ্চিত কর্মসংস্থান তরুণদের রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
এর বিপরীতে, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তরুণ প্রজন্ম সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নেপালে জেন জি আন্দোলনে সরকার পতন, মাদাগাস্কারে তরুণ আন্দোলনে নেতৃত্ব পরিবর্তন, ইন্দোনেশিয়ায় চাকরি সংকটবিরোধী বিক্ষোভে সরকারের ছাড় এবং বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে সরকারের পতনের ঘটনাগুলো উল্লেখযোগ্য।
তবে ভারতে এমন কোনো বিস্তৃত তরুণ আন্দোলন এখনো দেখা যায়নি। যদিও লাদাখে রাজ্যের মর্যাদা দাবিতে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে সহিংসতা দেখা দেয়, যা অধিকারকর্মী সোনম ওয়াংচুকের ভাষায় ‘জেন জি প্রজন্মের চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ’। অপরদিকে, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও বলেছেন, জেন জি প্রজন্মই ভোট জালিয়াতি ঠেকিয়ে সংবিধান রক্ষা করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের তরুণ সমাজের মধ্যে ঐক্যের অভাব বড় কারণ। নেপাল বা বাংলাদেশের মতো সংগঠিত নেতৃত্ব না থাকায় ক্ষোভটি স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে। ধর্ম, ভাষা ও জাতিভিত্তিক বিভাজনও একক আন্দোলন গড়ে তোলার পথে বাধা। কেউ বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত, কেউ জাতিগত বৈষম্য বা আঞ্চলিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার— ফলে অভিন্ন দাবিতে ঐক্য গড়ে ওঠে না।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ তকমার ভয়। দিল্লির এক তরুণ শিক্ষার্থী ধৈর্য চৌধুরীর ভাষায়, ‘ভারতে এখন প্রতিবাদ মানেই অনেকের চোখে দেশবিরোধিতা।’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মিছিল-মিটিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, যা একসময় ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল।
যদিও ভারতের সরকার সংশ্লিষ্টদের দাবি করছে, তরুণদের শক্তি উন্নয়নমূলক উদ্যোগে কাজে লাগানোই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব অনেক তরুণকে বিদেশমুখী করছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ১৮ বছর বয়সী ভোটারদের মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ নিবন্ধিত হয়েছেন; জরিপ বলছে, প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চান।
তবু এই প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা একেবারে নিস্তেজ নয়। তারা দেখেছে ২০১০-এর দশকের একাধিক আন্দোলন—আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভ, ২০১২ সালের দিল্লি ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ এবং ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব আইন ও কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু এসব আন্দোলনের পরিণতি— পুলিশি দমন, গ্রেফতার ও দেশবিরোধী তকমা তাদের সতর্ক করেছে।
ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্তের মতে, যুবশক্তি সব সময় সাময়িক; প্রতিটি প্রজন্ম নিজের প্রাসঙ্গিক ইস্যুতে জাগে, কিন্তু পূর্বসূরিদের লড়াই বহন করে না। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আজকের ভারতের জেন জি প্রজন্ম আপাতদৃষ্টিতে নীরব হলেও তাদের নীরবতার ভেতরে রয়েছে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও অপেক্ষমাণ শক্তি।
বিডি-প্রতিদিন/শআ