রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে প্রতিদিন সকাল-বিকালে মানুষ ও গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। চতুর্মুখী এই সড়কে গাড়ি থামারও কোনো উপায় নেই। এক পাশ বন্ধ থাকলে অন্য তিন দিক দিয়ে গাড়ি চলে। বেশির ভাগ পথচারী দৌড়ে পার হচ্ছেন গাড়ির ফাঁক গলিয়ে। কেউ অফিসের তাড়া, কেউ অভ্যস্ত নন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। অথচ তাদের মাথার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে ফুটওভার ব্রিজ, অব্যবহৃত, ধুলো জমে আছে রেলিংয়ে।
এই দৃশ্য শুধু বাংলামোটর এলাকা নয়; ফার্মগেট, নিউমার্কেট, মহাখালী, বনানী, কাকলীসহ প্রায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মোড়েই একই ছবি। এ ছাড়া পরীবাগ ফুটওভার ব্রিজটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ব্রিজটির একপাশে সিঁড়ির মাঝখানের অংশ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ব্রিজের প্রায় প্রতিটি সিঁড়িতেই মরিচা ধরে ছোট-বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে ব্রিজটি দিয়ে চলাচলকারীরা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পার হচ্ছেন।
রাজধানীতে স্থাপিত ৯৭টি ফুটওভার ব্রিজের মধ্যে ব্যবহারের হার ৩০ শতাংশেরও কম। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। বাংলামোটরে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা মুত্তাকিন সালেহীন নামে এক পুলিশ সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে চান না। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি চলন্ত অবস্থায় পার হয় মানুষ। আমরাও অনেক সময় গাড়ি বন্ধ করে তাদের পার হতে সাহায্য করি। তবে পাশেই ফুটওভার ব্রিজ। সেটা কেউ ব্যবহার করেন না।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ বলেন, ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে যেতে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট বেশি সময় লাগে। তার ওপর সিঁড়িও অনেক বেশি। ঘুরে যেতে হয়। তাই এত কষ্ট না করে কয়েক সেকেন্ডেই রাস্তা পার হওয়ায় যায়। জানি এতে জীবনের ঝুঁকি আছে।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে রাজধানীতে রাস্তা পার হতে গিয়ে নিহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার পথচারী। এর মধ্যে বেশির ভাগ ঘটেছে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও নিচ দিয়ে পার হওয়ার সময়।
এদিকে রাজধানীর বেশির ভাগই ফুটওভার ব্রিজে জমে থাকে ময়লা। চলন্ত সিঁড়িযুক্ত যে কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ আছে, সেগুলোর অধিকাংশেই অচল। দীর্ঘ সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ না করায় ফুটওভার ব্রিজগুলোর এই দশা বলে মনে করেন পথচারীরা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বনানী ও কাকলী চলন্ত সিঁড়ির ফুটওভার ব্রিজ দুটি অচল অনেক দিন ধরেই। সেখানে অবস্থান নিয়েছে ভাসমান হকার ও ভিক্ষুকরা। ফলে পথচারীদের বেশ ভোগান্তি নিয়ে হাঁটতে হয়। অনেক পথচারীকে বাধ্য হয়ে রাস্তার ডিভাইডারে লাফ দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে।
এর বাইরে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় সাধারণ যেসব ব্রিজ আছে, তার অধিকাংশই দীর্ঘদিন দেখভালের অভাবে প্রায় ভঙ্গুর অবস্থা। অনেকগুলোর ওঠার সিঁড়ি ক্ষয় হয়ে গেছে। চলাচলের অংশে দেখা গেছে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পান্থপথের পানি ভবনের সামনে, মিরপুর ১০ ও ১ নম্বরে এবং শাহবাগ ফুলের মার্কেটের সামনেসহ বেশ কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজেও এমন চিত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুটওভার ব্রিজের অবস্থান, নকশা আর ব্যবস্থাপনার কারণেই মানুষ তা ব্যবহার করতে চায় না। ফুটওভার ব্রিজের উচ্চতার কারণেও অনেকে উঠতে চান না। আবার কিছু ব্রিজ এত খাড়া ও নোংরা যে মানুষ উঠতেও ভয় পায়। অনেক ব্রিজে রাতে পর্যাপ্ত আলো নেই, ভিতরে ভিক্ষুক ও মাদকাসক্তদের বসবাস, আবার কোথাও অস্থায়ী দোকান দখল করে রেখেছে সিঁড়ি। কিছু স্থানে তো রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় ধাপে ধাপে ভাঙন ধরেছে। তাতে বিশেষ করে বয়স্ক ও নারী পথচারীরা এড়িয়ে চলেন।
গত সপ্তাহে রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় মারা যান ৪৫ বছর বয়সি এক ব্যক্তি। ঘটনাস্থলের পাশে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরেই ছিল ফুটওভার ব্রিজ। অনেকে দাবি তুলেছেন, শহরে নিরাপদ ‘জেব্রা ক্রসিং’ ও সিগন্যাল-নিয়ন্ত্রিত পারাপারের সুযোগ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোটি কোটি টাকার চলন্ত সিঁড়ি আজ অচল। অনেক ফুটওভার ব্রিজে মানুষ চলাচলের পরিবেশ নেই। ফুটওভার ব্রিজগুলো কেবল কাঠামো নয়, শহরের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার প্রতীক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলো এখন উপেক্ষিত স্থাপনা, যেখানে মানুষের উঠতে অনীহা।