ঘড়ির কাঁটার মতোই প্রতি বছর এই সময়ে ভারতের রাজধানী দিল্লী পুরু বিষাক্ত ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকে যায়। চোখ জ্বালা করে, গলা শুকিয়ে আসে। আর বাতাসের গুণমান সূচকগুলি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে দিল্লি এবং এর পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর বাতাসের গুণগতমান খুব খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের অন্যতম বড় উৎসব দীপাবলির পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আতশবাজির ধোঁয়ায় বাতাস ভরে গেছে। সংবাদ শিরোনামগুলো বলছে, এটি গত চার বছরের মধ্যে দীপাবলি-পরবর্তী সবচেয়ে খারাপ বায়ু গুণমান। এর ফলে শহরটি আবারও বার্ষিক বায়ু দূষণের মুখোমুখি।
এই বিষাক্ত বাতাসের জন্য এককভাবে কোনো একটি কারণকে দায়ী করা যাচ্ছে না। এটি আসলে একাধিক ঘটনার সমন্বয়। উৎসবের সময় অতিরিক্ত আতশবাজি ফাটানো। যানবাহনের ধোঁয়া। ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো।
শীতকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ঠান্ডা তাপমাত্রা এবং কম বাতাসের গতি এই দূষণকারী পদার্থগুলোকে মাটির কাছাকাছি আটকে রাখে। যা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে।
এ বছরও এই একই কারণগুলি কার্যকর বলে মনে করা হচ্ছে, তবে দূষণের জন্য কে কতটা দায়ী, তা নিয়ে রয়েছে বিপরীতমুখী প্রতিবেদন।
একটি জলবায়ু গবেষণা সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম জানায়, এ বছর বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় ফসলের নাড়া পোড়ানোর ঘটনা ৭৭ শতাংশ কমেছে। তারা উৎসবের সময় দিল্লির খারাপ বাতাসের জন্য মূলত আতশবাজিকে দায়ী করেছে। তবে, পিটিআই সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, পাঞ্জাবের সরকারি তথ্য অন্য কথা বলছে। আঞ্চলিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের মতে, গত ১০ দিনে রাজ্যে নাড়া পোড়ানোর ঘটনা তিন গুণ বেড়েছে। যেখানে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৬টি ঘটনার বিপরীতে এখন সাড়ে তিনশোরও বেশি ঘটনা ঘটেছে।
যদিও বিগত বছরগুলিতে সচেতনতামূলক প্রচার এবং বিকল্প যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবুও কৃষকদের কাছে নাড়া পোড়ানো এখনও সবচেয়ে সস্তা উপায় হওয়ায় এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না।
অন্যদিকে, দীপাবলির ঠিক আগে ভারতের শীর্ষ আদালত দিল্লী ও এর আশপাশের অঞ্চলে আতশবাজির পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। তারা দুই দিনে ছয় ঘণ্টার জন্য কম দূষণকারী সবুজ আতশবাজি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। তবে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করে বলেন যে সবুজ আতশবাজি মাত্র ২০-৩০ শতাংশ কম দূষণকারী। বাস্তবেও এই নিষেধাজ্ঞা খোলাখুলিভাবে লঙ্ঘিত হয় এবং নিষিদ্ধ আতশবাজিও অবাধে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এই দূষিত বাতাস সেবন করে দিল্লীর বাসিন্দারা কাশি, চোখ জ্বালা এবং শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন যে দীর্ঘমেয়াদী এক্সপোজার শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করে দেয় এবং গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
তবুও, এই মানবিক মূল্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের কাছে খুব কমই অগ্রাধিকার পায়। প্রতি বছরই শুরু হয় পরিচিত দোষারোপের পালা।
এ বছরও দিল্লী এবং পাঞ্জাবের সরকারগুলির মধ্যে তীব্র বাগযুদ্ধ চলছে। দিল্লির পরিবেশ মন্ত্রী পাঞ্জাব সরকারকে কৃষকদের নাড়া পোড়াতে বাধ্য করার অভিযোগ এনেছেন। জবাবে, পাঞ্জাবের শাসক দল আম আদমি পার্টি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে দিল্লী সরকারের বিরুদ্ধে দূষণ নিয়ে মিথ্যা বলার পাল্টা অভিযোগ করেছে।
বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ নাগরিকদের মতে, এই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো সম্মিলিত, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান। যেখানে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার একসঙ্গে কাজ করবে। প্রতি বছর শীতকালে সাময়িক, লোক দেখানো পদক্ষেপের উপর নির্ভর না করে।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুুল