ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ব্যাংক ও সমমনা প্রতিষ্ঠানের কাউকে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার দায়িত্ব না দিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) লিখিত দাবি জানিয়েছে বিএনপি। সূত্র জানিয়েছেন, ৩৬ দফার একটি প্রস্তাব প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে দিয়েছে দলটি। গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল বৈঠক করে। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ ও ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়া। এ তিনজন বিএনপি নির্বাচন কমিশনবিষয়ক কমিটির সদস্য।
‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকতাদের’ আগামী নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে চায় না বিএনপি। নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। গণভোটের বিষয়ে জানতে চাইলে মঈন খান বলেন, সাধারণ নির্বাচন হবে সেই দিনেই আমরা রেফারেন্ডাম চাই। গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
সিইসির সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদলের প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে মঈন খান বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ১০ লাখ লোকবল দরকার পড়ে। ‘বিতর্কিত যারা, প্রশ্নবিদ্ধ যারা রয়েছেন’ তাদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। এটা ছিল আমাদের আলোচনার মূল বিষয়। ভোটের পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ইসির প্রতি আস্থা ও গণভোট নিয়েও বৈঠকে আলোচনা করেন বিএনিপির প্রতিনিধিরা।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচনে প্রহসন হয়েছে। ১৫ বছরের কর্মকর্তারা ১৫ মাসে সংশোধিত হবেন না। একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে দায়িত্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। শুধু এই পাঁচজন নির্বাচন করতে পারবেন না এবং এর জন্য যে বিশাল একটি জনবল লাগবে, কমপক্ষে ১০ লাখ লোকের প্রয়োজন হবে নির্বাচনের।
বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের কথাও তুলে ধরেন তিনি। মঈন খান বলেন, গত ১৫ মাসে সবকিছু সংশোধিত হয়ে যাবে, এতটা আশা করা আসলে বাস্তবতা নয়। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে এবং এটাও বাস্তবতা। ইসি ইতোমধ্যে সচেতন আছেন তার পরেও আমাদের এ কথাগুলো বলা প্রয়োজন। সেই মূল কথাটি আমরা বলেছি এবং বিশেষ করে বিতর্কিত যারা, প্রশ্নবিদ্ধ যারা রয়েছেন, তারা যেন আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে অংশগ্রহণ করতে না পারেন, কোনো প্রভাব ফেলতে না পারেন, সে সম্বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভোটের আগে ভালো হবে এবং ভোটের দিন উৎসবমুখর হবে বলে আশা করে বিএনপি প্রতিনিধিদল।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশন যখন দৃশ্যমান করবে যে তারা একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায়, তখন ভয় কেটে যাবে এবং উৎসবমুখর নির্বাচন হবে। আমরা অনেকেই যে ভয়টা পাচ্ছি যে নির্বাচনের দিনে বিশৃঙ্খলা হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষতি হবে। বিশ্বাস করি যে নির্বাচন উৎসবমুখর, একটা কর্মকাণ্ডে পরিণত হবে এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আমরা যে আশঙ্কা করছি সে আশঙ্কা থাকবে না।
তিনি বলেন, একটি সম্পূর্ণ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন যেন হয়, সেই ব্যবস্থা তারা করবে। নির্বাচন কমিশনের যে মনোভাব আমরা দেখেছি, আমরা বিশ্বাসী যে তারা একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আগামীতে করতে সক্ষম হবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কারও সঙ্গে জোট করবে কি না জানতে চাইলে মঈন খান বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোয়ালিশন একটি স্বীকৃত পন্থা। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই এই প্রক্রিয়া চালু আছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা এখনো ওপেন রয়েছি। আমরা সময়মতো এ সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করব।
ইসলামী ব্যাংক ও সমমনা প্রতিষ্ঠান থেকে ভোট কর্মকর্তা নয় : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ব্যাংক ও সমমনা প্রতিষ্ঠানের কাউকে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার দায়িত্ব না দিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) লিখিত দাবি জানিয়েছে বিএনপি। সূত্র জানিয়েছে, ৩৬ দফার একটি প্রস্তাব প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে দিয়েছে দলটি। সেখানে বলা হয়েছে- নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা বা পোলিং পার্সোনাল তথা প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বমহলের কাছে চিহ্নিত এমন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না। যেমন- ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকে সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিয়োগ বাতিল করেছে এবং এসব শূন্য পদে তড়িঘড়ি করে দলীয় লোকজন নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সিইসির কাছে এ প্রস্তাব তুলে ধরে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোনো প্রস্তাব দিইনি।
সূত্র জানিয়েছে, অন্য প্রস্তাবগুলো হলো- প্রশাসনের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য এখনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে এই অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে হবে; ডিসি, এসপিসহ মাঠ প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে; ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের অবৈধ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সব বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আসন্ন নির্বাচনে কোনোরূপ দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না; রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের অফিসারদের পাশাপাশি ইসি কর্মকর্তাদেরও নিয়োগ দিতে হবে; নির্বাচনকালীন নির্বাচনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় জড়িত বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীসহ সব বাহিনীর কর্মকর্তার বদলি, পদায়ন, অবস্থান, দায়িত্ব ও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ইসির অধীন নিতে হবে; ভোটের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ সব বাহিনীর ভোট কেন্দ্রে কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে; নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালনে ইসির কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে; গোপন কক্ষ ব্যতীত ভোট কেন্দ্রের দৃশ্য বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করতে হবে সিসি ক্যামেরা; ভোটের সময়সূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক মাঠ নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন ও অভিযোগ প্রাপ্তির ১২ ঘণ্টার মধ্যে নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীদের অবহিত করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
এ ছাড়া নির্বাচনে সম্ভাব্য সব কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত ফলাফল নিশ্চিতকরণ; ভোট কেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি, পেশিশক্তি ব্যবহার ও প্রভাব প্রতিরোধ; নির্বাচনি এলাকায় বহিরাগত বহিষ্কার; নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সংবিধান ও আইনের প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে নির্ভীক হতে হবে; নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্ত হচ্ছে তা দেশ ও জাতির কাছে দৃশ্যমানের ব্যবস্থা গ্রহণ; ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত বিধান; কোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কর্তৃক বিতর্ক তৈরি করে এমন কোনো বক্তব্য যাতে না দেয় তার প্রাক্-ব্যবস্থা গ্রহণ; ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়- এমন সব অপপ্রচার রোধ; ভোটারদের প্রভাবিত করে এমন ধর্মীয় প্রলোভন বা ধর্মীয় দণ্ড প্রদানের ভীতি প্রদর্শন রোধ; অর্থ, দুর্নীতি ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থা; ভোট কেন্দ্র ভোটারদের কাছাকাছি নেওয়া অর্থাৎ কম সংখ্যক ভোটারের জন্য কেন্দ্র স্থাপন; ভোটের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার; ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিতদের কোনো গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ; ভোট কেন্দ্র ও তার বাইরে সন্ত্রাসী তৎপরতা তাৎক্ষণিকভাবে দমন; স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের তাদের নিজস্ব জেলায় দায়িত্ব প্রদান নয় ও দলের মতাদর্শধারীদের পর্যবেক্ষক হিসেবে অনুমতি নয়; আনসার ও ভিডিপি মোতায়েন কোনোক্রমেই নিজ জেলায় নয়; কমিউনিটি পুলিশকে কোনোভাবেই ভোট কেন্দ্রে মোতায়েন নয়; ছবিসহ ভোটার তালিকা পোলিং পার্সোনালসহ সব পোলিং এজেন্টদেরও যথাসময়ে সরবরাহকরণ; ভোট গণনা শেষ হওয়ার পর পরই ফলাফল কেন্দ্র থেকে সরাসরি ঘোষণা; প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ আইনানুগ স্বচ্ছতার সঙ্গে করা ও প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলকে যৌক্তিক সময়ের আগেই সরবরাহ করার প্রস্তাবও করেছে বিএনপি।