সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কর্তৃক নববধূ ধর্ষণ এবং হত্যার জঘন্যতম অপরাধের অতীত ঘটনাটি ১৩ অক্টোবর দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে! শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল- ‘স্বামীকে খুনের পর নববধূকে ধর্ষণ করেন সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল’! এত দিন ঘটনাটি লোকমুখে শোনা গেলেও এখন পত্রিকার শিরোনাম হিসেবে তা দেখতে পেলাম; কারণ ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর মোজাম্মেল হক টঙ্গী-গাজীপুর এলাকায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি হিসেবে দলবল নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় চলাফেরা করতেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না! ফলে তিনি একজন ভয়ংকর মানুষে পরিণত হয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে থাকেন! সে অবস্থায় এলাকার একজন সুন্দরী মেয়ে তার চোখে ধরে যাওয়ায় তাকে তিনি বিয়ে করতে চান। কিন্তু মেয়েটির পরিবার তার মতো একজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। সে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ায় সেই বিয়ের বরযাত্রীর গাড়ি থেকে বর-কনেকে অপহরণ করে সন্ত্রাসী মোজাম্মেল বরকে হত্যার পর তিন দিন ধরে মেয়েটিকে ধর্ষণ শেষে তাকেও হত্যা করে তুরাগ নদে লাশ ফেলে দেন!
ঘটনাটি আমি প্রায় ২০ বছর আগে গাজীপুরের লোকজনের মুখে শুনেছি। আমার এক শিল্পপতি বন্ধু গাজীপুরে তার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে যেতে মাঝেমধ্যে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন এবং ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের পর সেখানে আমরা দুপুরের খাবার খেতাম। তো সে সময়ে এলাকার একজন জমি ব্যবসায়ী (দালাল) যাকে মেম্বার নামে ডাকা হতো তিনিও আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিতেন। কারণ আমার বন্ধুর ফ্যাক্টরি নির্মাণের অধিকাংশ জমিই তিনি তার মাধ্যমে খরিদ করেছেন এবং আরও কিছু জমি খরিদের জন্য কথাবার্তা চালাচ্ছেন। সে অবস্থায় জমি দেখাতে গিয়ে কথিত মেম্বার আশপাশের জমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশে কোন জমিটি কে কিনেছেন সেসব তথ্যও জানিয়ে দিতেন এবং তার মাধ্যমে আজকের আলোচিত মোজাম্মেল হকের জমির অবস্থানও জানতে পারতাম। মেম্বার সাহেব আরও জানাতেন, গাজীপুর বনাঞ্চলে মোজাম্মেল হকের শত শত বিঘা জমি রয়েছে। মোজাম্মেল হক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং গাজীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় এসব জমি নিজ নামে করে নিয়েছেন, যার অধিকাংশই বন বিভাগের জমি! মোজাম্মেল হকের মেয়েসহ আত্মীয়স্বজনের অনেকেই আমেরিকা থাকে বিধায় হাতিয়ে নেওয়া বন বিভাগের অনেক জমি বিক্রি করে তিনি আমেরিকায় ধনসম্পদ গড়ে তুলেছেন বলেও তার কথায় জানা যেত!
এসব ঘটনা জানাশোনার মাত্র কয় বছর পরই মোজাম্মেল হকের আরও একটি দারুণ উত্থান দেখা গেল! সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে তাকে গাজীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য বানানোর পর ২০১৪ সালে আবারও এমপি বানিয়ে একজন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে তাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বানিয়ে দেন! অর্থাৎ একজন ধর্ষক, খুনি এবং বন বিভাগের শত শত বিঘা জমি হাতিয়ে নেওয়া ব্যক্তিকে দেশের মন্ত্রী বানানো হয়! তার অতীত অন্যায়, অপরাধ, অপকর্মের কোনো কিছুই এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না! যদিও আমরা সবাই জানি, স্বাধীনতার পর মোজাম্মেল হকের মতো ব্যক্তিদের খুন, ধর্ষণ, অপকর্ম, দুষ্কর্মের দায়ভার শেখ মুজিব সরকারের ঘাড়ে চেপে বসে। সেসব অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠায় একদল সৈনিক অভিযান চালিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকারের পতন ঘটিয়েছিল! শেখ হাসিনা মোজাম্মেল হক গংদের এতসব দুষ্কর্ম এবং অপরাধের খবর জেনেও তিনি তার মতো লোকদের মন্ত্রী, উপদেষ্টা বানিয়ে তাদের হাতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন! ফলস্বরূপ মোজাম্মেল হকের মতো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা তাদের স্রষ্টা শেখ হাসিনাসহ তার দলটিকেও ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছেন!
এ বিষয়ে এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। মোজাম্মেল হক মন্ত্রী থাকাবস্থায় আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই এই লোকটাকে মন্ত্রী বানিয়ে তো আপা বিরাট একটি ভুল করেছেন! সে তো ঘরে ঘরে বিবাদ-বিসম্বাদ বাধিয়ে দিচ্ছেন। নিজে উসকানি দিয়ে বানোয়াট অভিযোগ গ্রহণ করে ’৭১-এর রণাঙ্গনের কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধারও গেজেট, সনদ বাতিল করে দিচ্ছেন। আবার অনলাইনে দরখাস্ত গ্রহণের মাধ্যমে নিত্যনতুন মুক্তিযোদ্ধা বানাচ্ছেন! এসবের বিরুদ্ধে একটা কিছু লেখেন। তবে তিনি নিজেই বলেন, লিখে কোনো কাজ হবে না। কারণ জানেন তো, মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে আপা তাকে তার পাশের আসনটিতে বসান!’
বলাবাহুল্য সেদিন তিনি যে কথাটি বলেছিলেন দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছিল। কারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের ‘বীরউত্তম’ খেতাবটি বাতিল করে মোজাম্মেল হক তার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দেশের মানুষকে অবাক করে দিয়েছিলেন! তা ছাড়া তার মুক্তিযোদ্ধা গেজেট, সনদ বাতিল করার জন্য বিভিন্নভাবে অপপ্রচারও চালানো হয়েছিল! কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ বলেও একটি কথা আছে। প্রকৃতি ঠিকই তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে অবমাননা করার চেষ্টা তো সফল হয়ইনি, বরং মোজাম্মেল হক গং নিজেরাই অভিশপ্ত, অপমানিত হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন! যদিও দেশে এখনো মোজাম্মেল হকের লোকবল এবং সম্পদশক্তি বিদ্যমান। যার প্রমাণ, বিক্ষুব্ধ জনতা মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালানোর পর তার লোকজন তাদের কয়েকজনকে আটক করে মারধর করায় গুরুতর জখম কয়েকজনকে সেনাবাহিনী গিয়ে উদ্ধার করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঠায়!
এ অবস্থায় বর্তমানে যারা সরকার চালাচ্ছেন এবং পরবর্তীতে সরকার চালাবেন তাদের অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সেই সঙ্গে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে যে, আওয়ামী লীগের সবাই খারাপ নন। সুতরাং আওয়ামী লীগে যারা ভালো মানুষ আছেন তাদের আস্থায় আনার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। কয়েক দিন আগে আমি আওয়ামী লীগের সাবেক একজন এমপির ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলায় তিনি বললেন, ‘আওয়ামী লীগের কেউ অন্যায় অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু পাইকারি হারে সব আওয়ামী লীগারকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের নামে গণহারে মামলা দেওয়ার প্রবণতাও অপরাধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। নির্দোষ, নিরীহ, আওয়ামী লীগারদের নামেও মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন অনেক সুশীল ব্যক্তিকেও পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে! এসব ঘটনারও অবসান হওয়া উচিত। অন্যথায় যে লাউ সেই কদুই কিন্তু থেকে যাচ্ছে! অতীতের যেসব অপরাধের কারণে আওয়ামী লীগারদের বিচার করা হচ্ছে, সেই একই ধরনের কিছু অপরাধ এখনো ঘটে চলেছে!’ এ অবস্থায় তার কথাটিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মোজাম্মেল হকের মতো ধর্ষক, খুনি-অপরাধীদের ধরতে না পেরে, তার লোকজনের হাতে মার খেয়ে নির্দোষ, নিরীহ আওয়ামী লীগারদের ধরে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে পুলিশকে বাণিজ্যের সুযোগ করে দিলে সেসব ঘটনাও কিন্তু বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে! এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনায় জানা গেল, মফস্বলের একজন পিপি যিনি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাকেও একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে! পরিবারের প্রয়াত একজন সদস্য আওয়ামী লীগ করলেও তিনি কোনো দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার নামে খুনের মামলা দেওয়ায় তিনি ১৪ মাস ধরে পরিবার পরিজন বিচ্ছিন্ন হয়ে অসুস্থ অবস্থায় পলাতক জীবনযাপন করছেন! তা ছাড়া তিনি মফস্বল শহরে ওকালতি করলেও ঢাকার একটি হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে! তার অভিযোগ, দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতির কারণেই তাকে পলাতক জীবনযাপন করতে হচ্ছে! এসব বলার পাশাপাশি তিনি এ কথাটিও বললেন, অথচ অপরাধের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের ব্যক্তিরা আরাম-আয়েশে বিদেশে সময় কাটাচ্ছেন এবং দেশের ভালো এবং ভদ্র শ্রেণির আওয়ামী লীগারদের বিপদে ফেলে শেখ হাসিনাও নিরাপদে দিল্লিতে বসে আছেন!
এ অবস্থায় বলতে চাই, ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা কিন্তু মানুষকে পথভ্রষ্ট করে তোলে, অন্ধ করে ফেলে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছিল! সুতরাং শেখ হাসিনার মতো বর্তমান সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের মনমানসিকতায় একই চরিত্রের প্রতিফলন আমরা দেখতে চাই না! অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, অতীতের মতো এখনো মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেশের মানুষকে পুলিশি হয়রানিতে ফেলে একশ্রেণির পুলিশকে ফায়দা লোটার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে! অতএব এ প্রশ্নটি এসেই যায় যে, তাহলে পরিবর্তনটা হলো কোথায়? কারণ মব সৃষ্টির মাধ্যমে চাঁদাবাজি, মারধরের ঘটনাও অতীতের রাজাকার ধরা ইত্যাদি অপকর্মের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, নিজ কোম্পানির ট্যাক্স মওকুফের ঘটনাসহ অন্যান্য আরও অনেক দৃষ্টান্তও পতিত সরকারের আমলের সঙ্গেই খাপ খাচ্ছে! আর বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের কথা নাই বা বললাম। দু- একজন বাদে বাকিদের একেকজন ৪-৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে কে কী করছেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ কেউ কেউ আদৌ ফলপ্রসূ কোনো কিছু করতে পারছেন কি না সেসব প্রশ্নের পাশাপাশি তাদের সততা এবং নিষ্ঠা নিয়ে এখনই যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে ভবিষ্যতে সেগুলো যে আরও বড় আকার ধারণ করবে জনান্তিকে সে কথাটিও এখানে বলে রাখা হলো। আর তাদের কেউ যদি অন্যায়, অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, নিজের ইগো এবং স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেন, দেশের মানুষকে সুশাসনের পরিবর্তে অপশাসনের আবর্তে নিপতিত করেন সে ক্ষেত্রে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি তাদেরও এক দিন আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে! কারণ ক্ষমতার মসনদে চড়ে যে কেউ অন্যায়-অবিচার করলে, নিজের ইগো বাস্তবায়ন করলে, স্বার্থ হাসিল করলে তাদের সবাইকেও মনে রাখতে হবে যে, ‘ধর্মের কল কিন্তু বাতাসে নড়ে’।
লেখক : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা