প্রকৃতিতে এখন শীতের আগমনি বার্তা। ইট-পাথরের নগরী ঢাকায়ও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নামতে থাকে তাপমাত্রার পারদ। ফজরের সময় হিম কুয়াশায় ঢেকে যায় নগর। ঢাকার বাইরে গাঁওগেরামে শীত ইতোমধ্যে এক পা দিয়ে ফেলেছে। আসছে নভেম্বরে পুরোপুরি প্রবেশ করবে। শীত এলেই জমে ওঠে ওয়াজের মাঠ। একসময় ওয়াজ ছিল গ্রামবাংলার উৎসবের বড় উপলক্ষ্য। বছরে এক দিন বা দুই দিন মাহফিল হতো। স্থানীয় বা জাতীয় অলি-আউলিয়া, পীর-মাশায়েখ, বুজুর্গরা এসে দীনের কথা শোনাতেন। আখেরি মোনাজাতের আগে তওবা পড়াতেন। মোনাজাতে জার জার হয়ে কান্নায় বুক ভেসে যেত নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সবার। এ ধরনের মাহফিল মূলত মানুষের হেদায়াতের বাতিতে নতুন করে তেল পুড়ে দেওয়ার আয়োজন। বছরব্যাপী জ্বলত সে বাতি। বছরঘুরে আবার সাজানো হতো ওয়াজের প্যান্ডেল। টাঙানো হতো শামিয়ানা। এভাবেই একটা সময় গ্রামবাংলায় দীনের বাতি জ্বেলে রেখেছিল ওয়াজের মাঠগুলো। হায়! এখন সময় বদলেছে। পাল্টে গেছে ওয়াজের দৃশ্যও। এখন আর শীত-গ্রীষ্ম নেই। ঈদের দিনও চলে ওয়াজের আয়োজন। কিন্তু আগের ওয়াজের যে হেদায়াতি শক্তি ছিল, রুহানি তায়াজ্জুহ ছিল, কেন যেন সেটা জাতীয় জীবন থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। নয় তো এত ওয়াজ, এত দরস, আমরা সভ্য হচ্ছি না কেন? মানুষ হচ্ছি না কেন? প্রশ্নটি রেখেছিলাম সময়ের একজন আল্লাহওয়ালার কাছে। তিনি খুব সহজ ভাষায় বললেন, ‘সভ্য হওয়ার জন্য সাধনা করতে হয়। মানুষ হওয়ার জন্য মানুষের সংস্পর্শে থাকতে হয়। কামেল মানুষের সোহবতে থাকতে হয়। ওয়াজের মাঠগুলো আজ কামেল মানুষশূন্য। যে কারণে অনেক ওয়াজ হয়, অনেক ওয়ায়েজিনও আছে কিন্তু মানুষের জীবনে ওয়াজ কোনো প্রভাব ফেলছে না। পীরানে পীর দস্তগীর গাউসুল আজম হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেছেন, কলব জিন্দা আলেম যখন কোনো কথা বলে বা নসিহত করে তখন তার প্রভাব পড়ে। মানুষ তার কথা শোনে। আমল করে। আর কলব মরা আলেম যখন কোনো নসিহত করে, চাই তা যতই চমৎকার দলিলভিত্তিকই হোক তবু তা মরা মানুষের কথা। মরা মানুষের কথা কখনো অন্য মরা মানুষকে স্পর্শ করবে না। তাই কার থেকে ওয়াজ শোনা হচ্ছে তার বাতেনি এলেম কেমন সে সম্পর্কেও সজাগ থাকা প্রয়োজন।’
কলব জিন্দা মানুষ হয় কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে ওই আল্লাহওয়ালা বলেন, ‘এটা এক কঠোর সাধনার বিষয়। প্রথমে একজন খাঁটি পীরের কাছে মুরিদ হতে হবে। তুমি কোনো খাঁটি আল্লাহর অলির সোহবতে যাওয়ার পর তোমার ভিতরের যত নোংরা আছে সব নিংড়ে বের করে দেবেন তিনি। তোমার কাজ শুধু পীরের হুকুম তামিল করা। পীর যা বলেন, যেভাবে বলেন, সেভাবে করে যাওয়া। ফারসি মুরিদ শব্দটি এসেছে মুর্দা থেকে। মুর্দার নিজের যেমন নড়ার শক্তি নেই, তেমনি মুরিদের পীরের হুকুম ছাড়া নড়ার শক্তি থাকবে না। এভাবে তুমি যখন আল্লাহর মারেফাত পেয়ে যাবে তখন তোমার প্রথম পুরস্কার হবে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। দ্বিতীয় পুরস্কার হলো জিবরাইল তোমাকে ভালোবাসবেন। তৃতীয় পুরস্কার হলো, আসমানের সব ফেরেশতা তোমাকে ভালোবাসবেন। চতুর্থ পুরস্কার হলো, পৃথিবীর সব মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণিকুল সবাই তোমাকে ভালোবাসবে।’ খুব মজার একটি হাদিস শোনো। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন জিবরাইলকে ডেকে বলেন, ও জিবরাইল আমি ওমুক বান্দাকে ভালোবাসি। তুমি তাকে ভালোবাসো। জিবরাইল (আ.) সঙ্গে সঙ্গে আসমানের সব ফেরেশতাকে ডেকে বলেন, হে আসমানবাসী! তোমাদের রব অমুককে ভালোবাসেন। জিবরাইলও তাকে ভালোবাসে। সুতরাং তোমরা সবাই তাকে ভালোবাসো। এতে করে আসমানের বাসিন্দারা তাকে ভালোবাসতে শুরু করে এবং জমিনে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে যায়।’
একইভাবে আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিবরাইলকে ডেকে বলেন, ‘ওগো জিবরাইল! আমি ওমুক বান্দাকে ঘৃণা করি, তুমিও তাকে ঘৃণা করো। সঙ্গে সঙ্গে জিবরাইল ফেরেশতাদের উদ্দেশ করে বলেন, ওহে আসমানের বাসিন্দারা শোনো! তোমাদের রব ওমুক বান্দাকে ঘৃণা করেন। জিবরাইলও তাকে ঘৃণা করেন। সুতরাং তোমরা সবাই তাকে ঘৃণা করো। এতে করে আসমানের বাসিন্দারা তাকে ঘৃণা শুরু করে এবং জমিনে তার জন্য ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে যায়।’ (বুখারি, ৩২০৯; মুসলিম ২৬৩৭।)
♦ লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট