জুলাই গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে। হাজারো মানুষের জীবন, অজস্র মানুষের রক্ত, আর লাখো মানুষের অশ্রুতে অর্জিত এক নতুন স্বাধীনতা, যে ফ্যাসিবাদকে উপড়ে ফেলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিপরীতে বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, দেশের প্রতিটি মানুষের বঞ্চনার কষ্টকে ধারণ করে নেতৃত্ব দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে নতুন এক সূর্য। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের স্বপ্নকে ধারণ করে এই দেশকে সাজানোর নৈতিক দায়িত্ব নিয়েই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জন্ম। দেশের রাজনীতিতে আমরা আত্মপ্রকাশ করেছি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, যেখানে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলো দেশের নাগরিকদের অধিকার। আমরা মধ্যমপন্থি এক মানবিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাই, যা বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নাগরিক চেতনার সমন্বয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
এনসিপি ‘বাংলাদেশপন্থা’র রাজনীতি অর্থাৎ জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ, সাতচল্লিশের উপনিবেশ থেকে মুক্তি, একাত্তরের স্বাধীনতা এবং চব্বিশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার গণ আকাঙ্খা ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে গঠিত। দলটি সব ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করে সাম্য, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে। এনসিপি যেসব বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে চায় সেগুলো হলো-
১. উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণ অভ্যুত্থানের আদর্শে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন
এনসিপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নিহিত আছে মুক্তিযুদ্ধের গণ আকাঙ্খা ও আদর্শের মাঝে। সাম্য, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার রাজনীতি ছিল জাতির মুক্তির চেতনা। একইভাবে ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানকে এনসিপি গণমানুষের নয়া জাগরণের প্রতীক হিসেবে দেখে, যা বৈষম্য, স্বৈরতন্ত্র ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক নতুন বাংলাদেশর জন্ম দিয়েছে। এনসিপি একই সঙ্গে ১৯৪৭-এর পাকিস্তান আন্দোলন এবং ১৯০ বছর দীর্ঘ উপনিবেশকালে পূর্ববঙ্গের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব উপনিবেশবিরোধী ও ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাকে ধারণ করে; হিন্দু-মুসলমান-দলিতসহ সব জনগোষ্ঠীর মুক্তির আন্দোলনকে জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মূল্যায়ন করে। এই ঐতিহাসিক চেতনাই এনসিপির জন্য ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র নির্মাণের রাজনীতির প্রেরণা।
২. ধর্মীয় সম্প্রীতি, মানবিকতা ও নাগরিক মর্যাদার সহাবস্থান
এনসিপি ধর্মকে রাজনীতির প্রতিযোগিতার অস্ত্র কিংবা ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার বিতর্কে যেতে চায় না, বরং দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে নাগরিক জীবনের নৈতিক ও আত্মিক অংশ হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, নৈতিকতা ও সংস্কৃতিকে সঙ্গে এনসিপি রাজনীতি করতে চায়, একই সঙ্গে সব সংখ্যালঘু এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এগিয়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এর পাশাপাশি আমাদের রাজনীতি দেশে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সব ধরনের কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষ ও ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরোধী। আমাদের বিশ্বাস ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদ অথবা পাহাড়ের অধিকারের নামে সব ধরনের উগ্রবাদ এবং দেশের মেজরিটি জনগোষ্ঠীর ধর্মাচার ও জীবনরীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা ‘শাহবাগ ও ইসলামোফোবিয়া’ উভয়ই দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং আমাদের রাজনীতি দুই ধরনের প্রান্তিকতার বিরুদ্ধেই। সহজভাবে বলা যায়, এনসিপি প্রচলিত অর্থে সেক্যুলারিস্ট দলও নয় আবার থিওক্র্যাটিক দলও নয় বরং এমন এক গণতান্ত্রিক দল, যেখানে ধর্মীয় সহাবস্থান, দায়দরদ, ইনসাফ-আমানত ও পারস্পরিক সম্মান, জান ও জবানের নিরাপত্তার অধিকারের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠবে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐতিহাসিক সহাবস্থানের এই রাজনীতি হবে বাংলাদেশের নাগরিক ঐক্যের অন্যতম ভিত্তি।
৩. সভ্যতাগত জাতীয় পরিচয় ও জাতীয় সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ
এনসিপি দেশের রাজনীতিতে নানা ফেরকার মতাদর্শিক বিভেদ গড়ে দেওয়া বাঙালি ‘জাতিবাদী’ কিংবা শুধু ‘ধর্মভিত্তিক’ জাতীয় পরিচয়ের পরিবর্তে সভ্যতাগত জাতীয় পরিচয়ের ধারণা সামনে আনে। বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলে সহস্র বছরের ইতিহাস, সংগ্রাম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার মিশ্রণ ও অভিযোজনের ফলে যে অনন্য মানবিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে এনসিপি সেই সভ্যতাগত ঐক্যকেই জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দলটি এমন এক ‘বাংলাদেশপন্থা’র কথা বলে যা এই অঞ্চলের নদীবিধৌত পাললিক ইতিহাসের মতোই নানা ধরনের বৈচিত্র্যের ভিতরে ঐক্য, সহাবস্থানের ভিতরে সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকারের ভিতরে জাতীয় আত্মা ও পরিচয়কে খুঁজে পায়। অর্থাৎ বঙ্গ অঞ্চলে নানা ধর্ম, বর্ণ ও জাতির যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও মেলবন্ধনের ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যেই বর্ণাঢ্য ইতিহাস গড়ে উঠেছিল তার পুনর্জাগরণ ঘটাতে চায় এনসিপি। এই পন্থা বা মতাদর্শ যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে বা করতে চায় তা বিভাজন নয়, বরং সংহতির রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।
৪. নারী মর্যাদার ভিত্তিতে ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ
নারীর মর্যাদা নিশ্চিতকরণ ও ক্ষমতায়ন এনসিপির রাজনীতির অন্যতম মূলনীতি। এনসিপি মনে করে, নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, নেতৃত্ব ও কর্মসংস্থান রাষ্ট্রের দায়বদ্ধ দায়িত্ব। দলটি বিশেষভাবে মুসলিম পারিবারিক আইনের আওতায় সম্পত্তিতে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নেয়, যা নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকে পরিণত করবে। এই নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন সমাজে ন্যায্যতা ও পারস্পরিক সম্মানের এক নতুন ভারসাম্য গড়ে তুলবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর বিরুদ্ধে কাঠামোগত যেসব বৈষম্য রয়েছে তা থেকে উত্তরণের রাজনীতি করতে চায়। ব্যক্তিগত পরিসর থেকে শুরু করে জনপরিসর, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স থাকবে এবং তা প্রতিরোধে যথাযথ আইন নিশ্চিতকরণে আমাদের সংগ্রাম চলমান থাকবে। একই সঙ্গে এনসিপি যে কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা ও তাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়।
৫. আধিপত্যবাদবিরোধী ও ন্যায্য বৈদেশিক সম্পর্কনীতি
এনসিপি মনে করে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতিতে একক কোনো রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ এবং প্রতিবেশী যে কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ক হয়ে ওঠা হিন্দুত্ববাদের মতো মতবাদ বাংলাদেশের জন্য একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক হুমকি। এই আধিপত্যবাদের কাঠামোগত বিরোধিতার রাজনীতি করতে এনসিপি নীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ। তবে প্রতিবেশী যে কোনো দেশের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এনসিপি শত্রুতার নয় বরং ন্যায্যতা ও পারস্পরিক মর্যাদার কূটনৈতিক সম্পর্ক চায়। আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের উচিত সভ্যতা, ন্যায় ও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। মোট কথা এনসিপি এক স্বাধীন, আত্মমর্যাদাশীল ও ন্যায্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, যা ‘বাংলাদেশপন্থি কূটনীতি’র ভিত্তি হবে।
৬. ইনসাফভিত্তিক অর্থনীতি ও কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন
এনসিপি তার রাজনীতি দ্বারা বাংলাদেশে একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও ইনসাফভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চায়, যা একটি সত্যিকারের কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপ নেবে। এই অর্থনীতি মানুষের মৌলিক প্রয়োজন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর দাঁড়াবে। একটি শ্রেণি বা অঞ্চলের উন্নয়ন নয় বরং সামস্টিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এগোতে চায় এনসিপি। ইতোমধ্যে শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, শ্রম অধিকার, জলবায়ু ন্যায্যতা ও কর্মসংস্থান আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি নতুন অর্থনৈতিক সহযোগিতা অঞ্চল (Economic zone) গঠনের ভিশনও আমাদের রয়েছে, যা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তর করতে পারে। এর বাইরে দলিত সম্প্রদায়, কৃষক-শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক গবেষণা ও কর্মসূচির ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে এনসিপি।
৭. ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতি
এনসিপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, বিগত ৫৪ বছরের রাজনৈতিকীকরণ ও ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানসমূহ ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করেছে যেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব, বিচারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দমন করা হয়েছে, যার ফলে দেশের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতি তাই এনসিপির অন্যতম প্রধান প্রতিজ্ঞা। আমরা মনে করি, বর্তমান ঐকমত্য কমিশনের অধীনে প্রাথমিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠন ও সংবিধান সংশোধন হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার চালু রাখা জরুরি। এ ছাড়া প্রয়োজনে নতুন সংসদের সম্মতিক্রমে ফ্যাসিবাদী সংবিধান পুরোটা বাতিল করে সংশোধনীর অংশটুকু রেখে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। নতুন সংবিধান হবে এমন এক সামাজিক চুক্তি, যা নাগরিক অধিকার, জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিকে নিশ্চিত করবে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা চাই একটি ‘নাগরিক রাষ্ট্র’ গড়ে তুলতে যেখানে রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে জনগণের হাতে এবং ক্ষমতার লক্ষ্য হবে ন্যায় ও মানবিকতা। এলিট ও আমলাবান্ধব রাষ্ট্র সিস্টেম থেকে জনবান্ধব ক্ষমতার কাঠামো নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে চায় এনসিপি।
মোটকথা এনসিপির রাজনীতি এক ‘মানবিক মধ্যপন্থা’ যা ধর্মীয় অনুশীলন, নাগরিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ন্যায় ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। এটি মতাদর্শিক সংঘাতের রাজনীতি নয়, বরং নাগরিক অধিকার ও নৈতিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান। এনসিপির স্বপ্ন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে ধর্মবিদ্বেষ নয়, সম্প্রীতি জয়ী হবে; ফ্যাসিবাদ নয়, গণতন্ত্র বিকশিত হবে এবং ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব হবে রাজনীতির মূল নৈতিকতা।
লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি ও নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ (সিজিসিএস)