আমড়া মৌসুমি ফল। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো মৌসুমি গাছপালা ও ফলের সঙ্গে পৃথিবীর জীব হিসেবে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার মিল আছে। তাই মৌসুমি ফল খেলে মানুষ অনেকাংশে সুস্থ থাকে। আমড়া এমন একটি ফল দেখলেই তেঁতুলের মতো জিবে পানি আসে। আর এই টক-মিষ্টি আমড়া বিদেশি দামি আপেলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি গুণাগুণের অধিকারী এবং দামে সস্তা। এতে আপেলের চেয়ে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনের পরিমাণ অধিক। আমড়া একপ্রকার পর্ণমোচী বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম স্পনডিয়াস মমবিন। এই গাছগুলো ২০-৩০ ফুট উঁচু হয়। আর প্রতিটি যৌগিক পাতায় ৮-৯ জোড়া পত্র থাকে পত্রদণ্ডে যা ৮-১২ ইঞ্চি লম্বা। কাঁচা ফল টক বা টক-মিষ্টি হয়, তবে পাকলে টকভাব কমে আসে এবং বেশ মিষ্টি এবং সুস্বাদু হয়ে ওঠে। ফলের বীজ কাঁটাযুক্ত। অবশ্য ৫-৭ বছরেই আমড়া গাছ ফল দেয়। এই ফল কাঁচা ও পাকা রান্না করে বা আচার বানিয়ে খাওয়া যায়। এই ফল আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জন্মে।
বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আমড়া গাছ পরিলক্ষিত হয়। আমড়া অম্ল স্বাদযুক্ত। এতে প্রায় ৯০ ভাগ পানি, ৪-৫ ভাগ কার্বোহাইড্রেট ও সামান্য পরিমাণ প্রোটিন থাকে। আর ১০০ গ্রাম আমড়ায় ভিটামিন-সি পাওয়া যায় ২০ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৭০ মাইক্রোগ্রাম, সামান্য ভিটামিন-বি, ক্যালসিয়াম ৩৬ মিলিগ্রাম এবং আয়রন ৪ মিলিগ্রাম। আমড়ায় যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিনজাতীয় ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টজাতীয় উপাদান থাকে। এ ফলের পুষ্টিগুণ কোনো অংশে কম নয়।
আমড়া বেশ উপকারী ফল। এই ফল ভিটামিন-সিসমৃদ্ধ; কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন কমাতে সহায়তা করে; রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়; অ্যান্টি-অক্সিডেন্টজাতীয় উপাদান থাকায় আমড়া বার্ধক্যকে প্রতিহত করে; আমড়াতে প্রচুর আয়রন থাকায় রক্তস্বল্পতা দূর করতে বেশ কার্যকর; বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে আমড়া উপকারী; দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়ার মতো সমস্যা প্রতিরোধে আমড়ার ভূমিকা অনন্য; আমড়ায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকে বিধায় এই ভিটামিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রকমের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, সর্দি, কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে দূরে রাখে উপকারী এই ফল; হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়তা করে আমড়ায় থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি। এ ছাড়া ভিটামিন সি ত্বক সুস্থ রেখে বয়সের ছাপও কমায়; আমড়া খেলে মুখে রুচি বাড়ে, দূর হয় বমি বমি ভাবও; আয়রন শরীরের জন্য অপরিহার্য একটি অত্যাবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও রক্তস্বল্পতা এবং অন্যান্য রক্তের সমস্যা প্রতিরোধ করে।
এ ছাড়া হিমোগ্লোবিন এবং মায়োগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে আয়রন, যা শরীরের সমস্ত সিস্টেমে অক্সিজেন স্থানান্তর করে; আর আমড়ায় ফ্যাট ও সোডিয়াম নেই। এতে অনেক ভিটামিন ‘কে’ থাকে, যা হাড় মজবুত করতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমড়ায় কপার থাকে বলে হাড় ও শরীরের জন্য উপকারী; আমড়া পিত্তনাশক ও কফনাশক এবং থিয়ামিন নামের একটি উপাদান থাকে, যা মাংসপেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। এই উপাদানের ঘাটতি হলে পেশি দুর্বল হওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় আমড়া গাছ জন্মে। তবে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ; খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর ও বরগুনা; চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি; ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনা, শেরপুর এবং জামালপুর, ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল যেমন নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে অধিক জন্মে।
রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরের অনেক ছাদবাগানে অন্য গাছের সঙ্গে আমড়ার চাষ হয়ে থাকে। উঁচু ও মাঝারি জমিতে আমড়া ভালো জন্মে। এ দেশে আমড়া গাছে বর্ষায় ফুল আসে। তারপর বড় হতে থাকে এবং অক্টোবর পর্যন্ত বড় হয়। এই ফল হেমন্ত ঋতুর প্রথম সময়কাল পর্যন্ত দেখা যায়। আর এ সময় ফল পাকে। কিছুটা বড় হলে বাজারে আসতে থাকে, যা অক্টোবর পর্যন্ত বাজারে দেখা যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক